মানুষমন্ত্র: জীবনাদর্শের শৈল্পিক উচ্চারণ কিংবা ছায়া
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০২:২৫

মানুষমন্ত্র: জীবনাদর্শের শৈল্পিক উচ্চারণ কিংবা ছায়া

----------------

প্রকাশিত: ১১/০১/২০২৪ ১২:২৪:১৮

মানুষমন্ত্র: জীবনাদর্শের শৈল্পিক উচ্চারণ কিংবা ছায়া

মিজান মোহাম্মদের কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষমন্ত্র’র প্রচ্ছদ


সাইদুর রহমান সাঈদ : মিজান মোহাম্মদের কবিতায় তার দৃষ্টিভঙ্গির বহু মাত্রিকতা ও চিন্তার গভীরতার ছাপ রয়েছে। নিকষ কালো আঁধারেও তার কবিতার দ্যুতি ধবল জ্যোৎস্নার সাথে পাল্লা দেওয়ার যোগ্যতা রাখে। পরমা সুন্দরী রমনীর চিরল দাঁতের মুক্তোঝরা হাসির ঝিলিকের মতো প্রাণবন্ত কবিতা সৃষ্টির প্রয়াসে মিজান মোহাম্মদ বাল্যকাল থেকেই নিরন্তর সাধনায় লিপ্ত। তাই তার কবিতার অন্তরে-বাহিরে রয়েছে পরিশ্রম ও সাধনার ছাপ।

‘মানুষমন্ত্র’ মিজান মোহাম্মদের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। এটি অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯কে ঘিরে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশ করেছে চৈতন্য। মিজান মোহাম্মদ এ গ্রন্থটি তাঁর মা-বাবার নামে উৎসর্গ করেছেন। এটি সত্যিই প্রশংসনীয়। মানুষমন্ত্র গ্রন্থে বিভিন্ন স্বাদের ৪০টি কবিতা স্থান পেয়েছে। বইটির সেটআপ-গেটআপ-ছাপা-বাঁধাই চমৎকার। প্রচ্ছদেও রয়েছে মননশীলতার বিশুদ্ধ ছাপ। সব মিলিয়ে মানুষমন্ত্র কাব্যগ্রন্থটি কবিতার জগতে নিজের স্থান করে নিতে পারবে বলে আমার ধারণা।

মিজান মোহাম্মদের কবিতাগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে, জীবন ও জগতকে ভেঙ্গেচুরে দেখার নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং উপস্থাপনা কৌশলের অভিনবত্ব রয়েছে তার কবিতায়। প্রায় প্রতিটি কবিতায়ই তার গভীর জীবনবোধ ও প্রখর অন্তর্দৃষ্টির ছাপ রয়েছে। আমার মনে হয়েছে কবিতাগুলো কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার ফসল। তার লিখনশৈলী ও কথনশৈলীতে রয়েছে নতুনত্ব। তার কাব্যব্যঞ্জনার সরলতা সহজেই মানুষের হৃদয়ে নানা অনুভূতি সঞ্চার করতে বেগ পেতে হবে না। কবিতার প্রতি একজন কবির মমত্ববোধ, দায়িত্ববোধ, আত্মত্যাগ, অভিজ্ঞান প্রভৃতি যত প্রবল হবে, তার হাতে রচিত কবিতা ততবেশি শিল্পোত্তীর্ণ হবে।

বিশুদ্ধ কবিতা শক্তি ও সৌন্দর্যের আঁধার। অন্যভাবে আমরা বলতে পারি, কবিতা মানব সমাজে শক্তি ও সৌন্দর্যের প্রতিনিধিত্ব করে। সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে গাঢ় সবুজের সমারোহে প্রকৃতি যেভাবে উজাড় করে দেয় তার সৌন্দর্য, ঠিক সেই রকম সৌন্দর্যের স্পন্দন পরিলক্ষিত হয় মিজান মোহাম্মদের কবিতায়। আর অধিকাংশ কবিতাই-প্রচন্ড শক্তি বুকে ধারণ করে উজ্জ্বল হয়ে আছে এ গ্রন্থের পাতায় পাতায়।

শক্তি ও সৌন্দর্যের কারণেই কবিতা পরিবর্তনের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠতে পারে। সোঁদা মাটির গন্ধের মতো কবিতার ঘ্রাণ ছুঁয়ে যায় অর্ন্তলীন জগৎ। বৃষ্টির জলরাশির মতো প্রাণবন্ত, চঞ্চল ও সতেজ মিজান মোহাম্মদের অধিকাংশ কবিতাই শিল্পমূল্য ও কালের বিচারে উত্তীর্ণ হওয়ার দাবি রাখে। তার কবিতার রজনীগন্ধার মিষ্টি মাতাল গন্ধের মতো রোমাঞ্চকর অনুভূতির প্রকাশ কবির দক্ষতার পরিচয় বহন করে।

মানুষের জীবন ও জীবন সংগ্রামের বৈচিত্রময়তা নিয়ে যে নতুন পৃথিবীর নতুন আবেদন তা মূর্ত হয়ে ওঠেছে এ গ্রন্থের অনেক কবিতায়। এখানে কবির সুক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ গভীর মূল্যায়নের দাবি রাখে। কবির আত্মানুসন্ধান ও আত্মউন্মোচনের নতুন পথ, পদ্ধতি ও ধারাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। নির্জনতার নিঝুম দ্বীপে স্বপ্নের স্বর্গের মতো মনে হয় তার কবিতা, মিজান মোহাম্মদের কবিতা অন্ধকারের ভেতর আলোর ঝলক। জলের মতো চঞ্চল ও গতিশীল তার কবিতা। কবিতার প্রবহমানতা সময়কে অতিক্রম করার প্রয়াস বলেই মনে হয়।

কবিতার অনিবার্য অনুষঙ্গ উপমা, উৎপেক্ষা, রূপক, চিত্রকল্প, প্রতীক, রূপকল্প প্রভৃতি ব্যবহারে মিজান মোহাম্মদ দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন বলেই তার কবিতা উৎকর্ষতার বিচারে উৎরে গেছে। কবিতার একজন কবির জীবনবোধ কল্পনাশক্তি, অভিজ্ঞতা, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আশা-আকাঙ্খা, হতাশা-বেদনা, প্রেম-বিরহসহ যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ ওঠে আসে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।

মিজান মোহাম্মদ এর ব্যতিক্রম নন। তার কবিতায় আবেগ-অনুভূতি-জীবনজিজ্ঞাসা শিল্পময় হয়ে ওঠেছে।আসলে কবিতা নিবিড় পাঠ ছাড়া তার ভেতরের শক্তি, সৌন্দর্য ও উষ্ণতা উপলব্ধি করা যায় না। বোদ্ধা পাঠকের পক্ষেই কবিতার রসাস্বাদন করা সম্ভব। মিজান মোহাম্মদের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের নানা দ্বন্ধ-সংঘাত সংশয় ও অসঙ্গতির খণ্ডচিত্র ওঠে এসেছে। এ গ্রন্থের কবিতাগুলোতে তিনি নিজের স্বতন্ত্রস্বর ও নিজস্ব কাব্যভাষা সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। কবিতার কাঠামোতেও নতুনত্বের ছাপ রয়েছে। মিজান মোহাম্মদের কবিতা মানুষের মনস্তত্বের সু²তায় জগতকে হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে অনুভব করার এক আবেগময় জিজ্ঞাসা। কবির অজান্তে বা অবচেতনের কোনো কোনো সময় সেই জিজ্ঞাসা সভ্যতাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে। ভ্রাম্যমাণ মেঘের ছায়ার ভেতর দিয়ে ওড়ে যাওয়া মানুষের মনস্তত্ব বুঝতেও চেষ্টা করেন একজন বিশুদ্ধবাদী কবি।

কবির জীবন দর্শন তাকে তাড়িত করে। তখন কবিতার পংক্তির ভেতর থেকে ঠিকরে পড়ে আলো। কবি সময় ও সমাজের ভাষ্যকার । তাই তিনি কবিতার মাঝে সময় ও সমাজচিত্রকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। একজন কবি তার স্বদেশ ও স্বজাতি এবং গোটা মানব জাতির প্রতি তার দায়বোধকে অবহেলা করতে পারেন না। কবির কণ্ঠস্বর যখন সর্বমানসের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়, তখন তার কবিতা সাবর্জনীন ও সফল হয়ে ওঠে। মিজান মোহাম্মদ তার কবিতাকে সার্বজনীন করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, একজন কবির পক্ষে মানুষের মনস্তাত্বিক জটিলতা ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য রহস্যময়তার কতোটুকু বুঝা বা উপলব্দি করা সম্ভব?

বৈচিত্রময় জীবন কিংবা জীবন সংগ্রামের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে যে মনস্তাত্বিক ঘোর সৃষ্টি হয়, সেই ঘোরের পাঁকচক্রে অনেক কিছুই তলিয়ে যায়। কবির প্রগাঢ় জীবনবোধ ও চিন্তাশক্তির ছায়া আমরা দেখি তার কবিতায়। যেমন-

‘আজও পাখির সঙ্গম পোড়ে প্রতিটি দুধজোছনায়/ যে জোছনাপোড়া শ্বেত-শুদ্ধ সঙ্গম/ কচলে কচলে খায় মানুষ, ছেলান সময়ে/ আউশের ধান, না মাটি বিলায় সোঁদাগন্ধ, যেখানে মিশে যায় মাইনষের সাথে.../ হাঁপিয়ে ওঠা এমন প্রতিটি অমসৃণ রাতে/ আমার পোয়াতি স্বপ্নগুলো প্রসব করে/ কিছু মানুষমন্ত্র...’ (মানুষমন্ত্র)।

প্রেম ও প্রকৃতির অপরিসীম সৌন্দর্য শক্তি কবির মনোজগতে আলোড়ন তুলে। নানান রঙের স্বপ্ন দোলা দিয়ে যায় তার মনের গহিনে। কবির হৃদয় থেকে ওঠে আসে জীবনঘনিষ্ট উচ্চারণ-

‘নিষিদ্ধ সময় নিষিদ্ধ যাত্রা মানে না ফাগুনের আগুন/ লজ্জায় রঙিন কপোল ঠেলে দেয় উন্মাদনায়/ আর আমিও একদিন একেকটা-/ চিরবসন্তের দেশ হয়ে যাই প্রিয়তা।/ তুমি ‘গ্রীষ্মকাল গ্রীষ্মকাল’ বলে যতই মিছিল করো/ তোমার ঋতুমতী হাসির ঝিলিক আমাকে আরো/ উন্মাদ করে তুলে। (নোঙর)

জীবনের খতিয়ান খুলে দেখার মতো জাগতিক বিষয়-আশয় ওঠে এসেছে মিজান মোহাম্মদের কবিতায়। কবিতায় তার শৈল্পিক ও সাহসী উচ্চারণ তাকে নিজস্বতার দিকে নিয়ে গেছে। কিন্তু এই শ্বাপদ সংকুল জগতে তিনি অভয়ারন্য কোথায় খুঁজে পাবেন? দেখা যাক অভয়ারণ্য সম্পর্কে তার চিন্তাচেতনা বা দৃষ্টিভঙ্গি-

‘প্রকট রৌদ্র-মরু হাওয়ায় ভেসে ভেসে চলে/ দুটি তৃষ্ণার্ত মন/ কয়েক ফোঁটা উষ্ণ জলের স্পর্শের জন্য/ নদী আর নৌকা অসহ্য যন্ত্রণায় বার বার/ রাজদ্রোহীর মতো প্রতিবাদে মাথানাড়ে/ পর্দার অন্তরালে...।’ (অভয়ারণ্য)

মিজান মোহাম্মদের কবিতায় প্রেম ও দ্রোহ আছে, বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার কথা আছে, মান-অভিমানের কথা আছে, মানুষের আশা-আকাঙ্খা-ভালোবাসার কথা আছে, বৈশাখি স্বপ্ন আছে। রাতের তারার নীল কথা আছে, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অধপতনের কথা আছে, আহত স্বপ্নগুলোর আর্তনাদের কথা আছে, মানুষ ও মানবতার কথা আছে। মানবজীবন সম্পর্কিত যা কিছু সবকিছুই আছে তার কবিতায়। প্রেমিকার হাত ধরে জ্যোৎস্নার জোয়ারে সাতার কাটার সৌভাগ্য সবার হয় না।

প্রেমিকার হাত ধরে সাগরের অপার সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না। কিন্তু মিজান মোহাম্মদের হয়েছে। এ গ্রন্থের ‘কারিগর’ কবিতায় এ রকম ইঙ্গিত আমরা পাই। এ রকম সংলাপধর্মী কবিতা কবির চিন্তা-চেতনায় নতুনত্বের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। কবির জীবনঘনিষ্ট ‘উচ্চারণ’ এক টুকরো জমি চাই তার সাহসী উচ্চারণ ‘প্রিয়তা- কবিরা দেবালয়ের দেবতা নয়, এরা বেশ্যালয়ের ইজারাদার...।’

‘দেবতা সঙ্গম’ কবিতায় স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ‘উপহাস’ কবিতায় কিছু কিছু মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের প্রতিচিত্র ও ‘দুধজোছনায় গোপন কথার বৃষ্টি’ কবিতায় জীবনের জটিল সমীকরণের চিত্র এঁকেছেন। মিজান মোহাম্মদের কবিতাগুলোর প্রতিটি পংক্তিই উলে­খ করার মতো। মনে হয় একটি পংক্তি থেকে আরেকটি পংক্তি শক্তিশালী। ‘চিরকুট’ কবিতায় কবির আক্ষেপ-

‘যদি আঁকতে ভালোবাসার সারমর্ম/ তবে আমাকে আজ সিঁড়ি মাপতে হত না গো কুসম।’

এরকম অসংখ্য হৃদয়গ্রাহী পংক্তির সমাহার মিজান মোহাম্মদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষমন্ত্রে’ তার অনেক কবিতায় রোমান্টিক উচ্চারণে করুণ বাস্তবতা ফুটে ওঠেছে। তার কোনো কোনো কবিতায় আধ্যত্মিকতার ছাপ রয়েছে। কবিতাগুলো নানান রঙের ও নানা বর্ণের অগণিত ফুলের সমাহার। শব্দশ্রমিক বা শব্দের কারিগর হিসেবে মিজান মোহাম্মদ প্রশংসার দাবি রাখেন। এ গ্রন্থের জন্য কবিতা নির্বাচনে তিনি মোটেই দুর্বলতার পরিচয় দেননি।

ব্রিটেনের সাম্প সময়ের একজন সাড়া জাগানো কবি ক্যারল অ্যান ডাফি তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি তোমার কাছে একটা ছবির মতো যা তুমি তোমার জিহবা দিয়ে আমাকে এঁকেছ, মুছেছ, রঙিন করেছ, শিরোনামহীন করেছ, আবার নামাঙ্কিত করেছ।’ প্রথম কাব্যগ্রন্থেই প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ কবি মিজান মোহাম্মদ যে স্বকীয়তার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সাহিত্যচর্চায় আরো বেশি মনোনিবেশ করলে তার কাব্যভাষা আরো শক্তিশালী হবে বলে আমার বিশ্বাস।

মানুষমন্ত্র কাব্যগ্রন্থের বহুল প্রচারই আমার কাম্য।

প্রতিষ্টাতা সভাপতি, বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব

সিলেটজুড়ে


মহানগর