সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : সুনামগঞ্জের প্রধান নদী সুরমাসহ অভ্যন্তরীণ একাধিক শাখা নদী পলিমাটি জমে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে। ফলে একাধিক শাখা নদীর কোন কোন স্থানে স্বাভাবিক নৌযান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কোথাও ডিঙ্গি নৌকাও চলাচল করতে গিয়ে নদীর তলদেশে আটকে যাচ্ছে। জেলার ২৬ টি ছোট-বড় নদীসহ অভ্যন্তরীণ শাখা নদীগুলো বছরের পর বছর নৌযান চলাচলের মাধ্যমে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
পলিমাটি জমে গভীরতা কমে যাওয়ায় কোন কোন স্থানে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার যে সব শাখা নদীতে সামান্য পানি রয়েছে সেখানে মৎস্য শিকারের জন্য নদীর অনেকাংশে বাশের খুঁটি দিয়ে ঘের তৈরী করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় নৌযান চলাচল না করতে পারায় ব্যবসায়ী ও কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ পণ্যপরিবহনে বিকল্প পথ ব্যবহারে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
জানা গেছে, সুনামগঞ্জের প্রধান নদী সুরমা মেঘালয় থেকে এসে পূর্ব-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। বরাকের মূল স্রোতের সঙ্গে উত্তর থেকে নেমে আসা পাহাড়ি নদীগুলো সুরমার নাব্যতাকে যেমন করেছে পরিপূর্ণ, ঠিক তেমনি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত সুরমা থেকে উৎপন্ন সুরমার শাখা নদীগুলো বিস্তৃত সমতল হাওর এলাকাকে করেছে সবুজ ঘেরা শ্যামল প্রকৃতির।
সুরমার শাখা নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মরা সুরমা, ধনু, বৌলাই, রক্তি, পান্ডার খাল, গোয়ারাইর খাল, মহাসিং, কালনি, মাছুখালী ইত্যাদি। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হওয়ার সময় নতুন নামেও পরিচিতি পেয়েছে এই নদী। যেমন পান্ডার খালের দক্ষিণ-পশ্চিমের অংশ মহাসিং নদী নামে পরিচিত।
তেমনি দিরাই উপজেলায় গিয়ে মরা সুরমার একাংশের নাম হয়েছে কালনী নদী। জামালগঞ্জের কোথাও রক্তি, বৌলাই, ধনু নামে পরিচিত হয়েছে। পাহাড়ী ঢলে পলি জমে সুরমার শাখা এসব নদীর সবই নাব্যতা হারিয়ে এখন মরণ দশায় পরিণত হয়েছে। একসময় এই নদীগুলো উত্তাল যৌবনাপূর্ণ ছিল, এখন কানো কোনো অংশ শুকিয়ে হেমন্তে গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনোটি হারিয়ে গেছে হাওরের বোরো জমিতে।
বিভিন্ন নদী এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে এলাকাবাসী ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের মেঘালয় থেকে উৎপন্ন হওয়া যাদুকাটা ও ধোমালিয়া নদী সমতল ভুমিতে নেমে এসে সুরমা নদীর সাথে মিশে পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে বাঁকা হয়ে ধনু নাম ধারণ করে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে।
মেঘালয় পাহাড় থেকে বেয়ে আসা সুনামগঞ্জ ঘেঁষে সুরমা নদী, আবার জামালগঞ্জ সদরের দুর্লভপুরে রক্তি নদী, ভাটির দিকে বৌলাই নদী নামে পরিচিত হয়েছে। এই নদী নেত্রকোনা মোহনগঞ্জ-খালিয়াজুড়ি বিভিন্ন এলাকা হয়ে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর মেঘনার মোহনায় মিলিত হয়েছে। শুকনো মওসুমে নদীর কোন কোন অংশে নৌযান চলারও সুযোগ থাকেনা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সুরমা নদী সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার পৈন্দা এলাকায় এসে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১১৬ কিলোমিটার দৈঘ্যর্ বিশিষ্ট একটি ধারা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে চলে যায় দিরাই উপজেলায়। অপরটি উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে জামালগঞ্জ হয়ে মেঘনার মোহনা মিশেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমের ধারাটি নিকট অতীতে ছিল সুরমার মূল স্রোতধারা।
কিন্তু পলি জমে ভরাট হতে হতে বদলে গেছে একসময়ের স্রোতস্বিনী এই নদীটির দৃশ্যপট। বর্ষায় কোনোমতে নাব্যতা টিকে থাকলেও হেমন্তে নদীটি হয়ে পড়ে মৃতপ্রায়, যে কারণে সুরমার মূলধারা এখন সাধারণ মানুষের কাছে ‘মরা সুরমা’ হিসেবে পরিচিত। দিরাই’র রাজানগর ইউনিয়নের গচিয়া থেকে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর পর্যন্ত নদীর অনেক জায়গায় পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নারায়নপুর গ্রাম থেকে দিরাই উপজেলার শরিফপুর পর্যন্ত ১০-১২ কিলোমিটার নদী পলিতে ভরাট রয়েছে।
এদিকে সুরমার অপর বড় শাখানদী পান্ডার খাল, যেটি দোয়ারাবাজার উপজেলার ইদনপুর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও জগন্নাথপুর উপজেলা হয়ে প্রায় শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মিশেছে কুশিয়ারা নদীতে। পান্ডার খাল মরে যাওয়ার পর মহাসিং হিসেবে পরিচিত হয়ে এটিও মৃতপ্রায়।
পরিবেশবাদী সংস্থা সেন্টাফর ন্যাচারাল রির্সোস ষ্টাডিজ (সি.এন.আর.এস) এর পরিবেশ-উন্নয়ন কর্মী জুলফিকার চৌধুরী রানা জানান, সুরমা নদী ঘেঁষা জামালগঞ্জের ফেনারবাঁক ইউনিয়নের রামপুর মোড় ও গজারিয়া থেকে আমানিপুর পর্যন্ত প্রায় নদী ভরাট হয়ে সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
সুরমা ও শাখা নদী খননের দাবী জানিয়ে পরিবেশ উন্নয়ন কর্মী বলেন, সুরমা নদী না বাঁচলে হাওরে ভাল ফসল ফলানো সম্ভব না, ফসল ভাল না হলে কৃষক বাঁচবেনা। দ্রুত নদী খননের জন্য সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট তিনি দাবী জানান। নদী ভরাট ও সংকুচিত হওয়ার কারণে, নদীকে কেন্দ্র করে আবহমান কাল থেকে হাওরাঞ্চলে গড়ে ওঠা নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। সুরমা ও শাখা নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে। এতে মানুষের ভোগান্তির পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গিয়ে হাওরের ওপর দিয়ে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণ হচ্ছে। ফলে হাওরের পরিবেশ, প্রতিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এতে মাছের উৎপাদন ও বংশবিস্তার ধ্বংসের পথে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান বলেন, নদীতে পলি জমার কারণে অনেকগুলো নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু নদীর খনন কাজ চলছে। উজানে কিছু নদী খনন করার জন্য প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছে। সম্পূর্ণ খনন কাজ শেষ হলে জেলার অন্যতম বৃহৎ সুরমা নদীটি নাব্যতা ফিরে পাবে। ভরাট হয়ে যাওয়া সব নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে খননের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।