৩১ জুলাই ২০২২


দেশে ‘অরক্ষিত’ ২০০০ লেভেলক্রসিং

শেয়ার করুন

আজকের সিলেট ডেস্ক : রেলপথে ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে লেভেলক্রসিংয়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে কিংবা ধাক্কা খেয়ে অন্তত ২১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ৮৩ শতাংশই ঘটছে রেলক্রসিংয়ে। এসব দুর্ঘটনার পেছনে অন্যতম তিনটি কারণ হলো অবৈধ রেলক্রসিং বা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় না করে রাস্তা তৈরি; বৈধ ক্রসিংয়েও গেটম্যান না থাকা এবং পারাপারের সময় জনসচেতনতা না থাকা।

রেলওয়ের তথ্য বলছে, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে মিলে সারাদেশে ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬১টিরই অনুমোদন নেই অর্থাৎ অবৈধ। আবার বৈধ ১ হাজার ৪৯৫টির মধ্যে ৬৩২টিতে গেটম্যান নেই।

লেভেলক্রসিং ৪ ধরনের। স্পেশাল, এ, বি এবং সি ক্যাটাগরি। স্পেশাল ক্যাটাগরিতে ২৪ ঘণ্টায় ৩ জন করে গেটম্যান দায়িত্ব পালন করে। এ ক্যাটাগারিতে একই সময়ে ২ জন গেটম্যান দায়িত্ব পালন করে। বি ও সি ক্যাটাগরিতে কোন গেটম্যান নেই।

জাতীয় মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কের মধ্যে যে লেভেল ক্রসিং পড়েছে সেগুলোর মান এ প্লাস, বি প্লাস ও সি প্লাস। মহাসড়কের এ প্লাস গেটে ৩ জন গেটম্যান, বি প্লাস গেটে ২ জন গেটম্যান দায়িত্ব পালন করে। আর কিছু লেভেল ক্রসিং আনম্যানড বা অরক্ষিত।

এসব রেলক্রসিংয়ের বেশিরভাগই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর—এলজিইডির অধীনে থাকা সড়কে। পাশাপাশি আছে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) সড়কে।

রেলওয়ে গত এক দশকে রেললাইন তৈরি ও কেনাকাটায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সওজ প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করছে। কিন্তু রেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কেউ দায়িত্ব নিতে চাইছে না।

সাত মাসে ৯৫২ দুর্ঘটনা, নিহত ২১৬, আহত ১১৪০
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রেলপথে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৬টি। এসব দুর্ঘটনায় ১৪ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি আহত হন ৫২ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ৪১টি দুর্ঘটনায় ২৭ জনের মৃত্যু আর আহত হন ১১১ জন। মার্চ মাসে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২২২টি। এতে নিহত হন ৩১ জন। আহত হন ১৮৬ জন।

এপ্রিল মাসে রেলপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ১১২টি। নিহত হন ৪২ জন। আহত হন ১৬৬ জন। মে মাসে ২১২টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৩ জন। আহত হন ২২১ জন। জুন মাসে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি। নিহত হয়েছেন ১৭ জন। আহত হন ১৭২ জন। আর জুলাই মাসে ঈদযাত্রাসহ ১৪২টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৪ জন। আহত হন ২৩২ জন।

বছরের পর বছর বন্ধ স্থায়ী গেটম্যান নিয়োগ
রেলওয়ে সূত্র জানায়, লেভেলক্রসিংয়ে কর্মরত ৭৫ শতাংশ দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে সাধারণ লোক দিয়ে কাজ করানো হয়। অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্তরা প্রশিক্ষিত নয়। দায়িত্ব পালনে অনেক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। আবার পালাবদলে সময়মতো পরবর্তী গেটম্যান না আসায় অনেকটা সময় অরক্ষিত থাকে।

বিগত ২০১৪ সালে লেভেল ক্রসিং উন্নয়নে অস্থায়ী গেটম্যান নিয়োগ প্রকল্পের আওতায় ১শ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা। ইতোমধ্যেই ওই অর্থে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথের গেটম্যানের বেতন দিতে ৬৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বাকি ৩৬ কোটি টাকায় পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের বৈধ লেভেলক্রসিংয়ে রক্ষণাবেক্ষণের ২৬ শতাংশ কাজ হয়েছে।

১৯৮৪ সালের পরে রেলে কোনো স্থায়ী গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ২০১৮ সালে এক হাজার স্থায়ী গেটম্যান নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু কোনও এক জটিলতায় দুবছর ধরে ওই নিয়োগ বন্ধ।

সাবেক দুই ডিজির চেষ্টাতেও দিশা মেলেনি
রেলওয়ে সূত্র বলছে, নতুন রেললাইন তৈরি করে প্রথম ট্রেন চালানোর ১০ বছরের মধ্যে এর ওপর দিয়ে কোনো সড়ক গেলে তা সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব রেলের। এরপর কোনো সড়ক নির্মাণ হলে তা আগে রেল কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। সড়কের কারণে তৈরি রেলক্রসিংয়ে পথরোধক ও পাহারাদার দিয়ে তা সুরক্ষণ করার দায়িত্ব সড়ক নির্মাণকারী সংস্থার।

২০১৩ ও ২০১৯ সালে তৎকালীন রেলের দুজন মহাপরিচালক এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীকে অনুমোদনহীন ক্রসিং ও দুর্ঘটনার ফিরিস্তি দিয়ে চিঠি লেখেন। চিঠিতে বলা হয়, অবৈধ ক্রসিংয়ের কারণে নিরাপদে ট্রেন চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। দুর্ঘটনায় মানুষের জানমালের ক্ষতি হচ্ছে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, এরপর এলজিইডি থেকে গতবছর একটি চিঠি দিয়ে রেলকে জানানো হয়, এলজিইডি নিজেরা কোনো নতুন সড়ক নির্মাণ করে না। সংসদ সদস্যদের লিখিত সুপারিশের ভিত্তিতে তারা ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদসহ অন্য সংস্থার সড়ক উন্নয়ন করে থাকে। ফলে রেলক্রসিংয়ের দায় পুরোপুরি তাদের নয়।

সরকারের কমবেশি পাঁচটি সংস্থা রেললাইনের ওপর সড়ক নির্মাণ করার কারণে রেলক্রসিং সৃষ্টি হয়েছে। রেলের নিজেদেরও রেলক্রসিং আছে। রেলসহ এই সরকারি সংস্থাগুলো গত এক দশকে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। কিন্তু রেলক্রসিং সুরক্ষায় কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। দায় চাপাচ্ছে একে অপরের।

রেলওয়ে আইনে রেলক্রসিংয়ে মৃত্যুর জন্য কোনো ক্ষতিপূরণেরও ব্যবস্থাও নেই। অন্য সংস্থাগুলো প্রাণহানির বিষয়টি আমলেই নেয় না। ফলে একের পর এক রেলক্রসিংয়ে মানুষ মারা গেলেও নেই কোনো জবাবদিহিতা।

৩৫০ লেভেলক্রসিং সুরক্ষিত করতে চার প্রস্তাব
রেলক্রসিং নিরাপদ করার দুটি উপায় রয়েছে। তার মধ্যে প্রথমে রয়েছে রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া সড়কে উড়ালপথ নির্মাণ করা। আর ট্রেন আসার সময় যানবাহন আটকে দেওয়ার জন্য পথরোধক (ব্যারিকেড) বসানো এবং ট্রেন এলে তা সময়মতো নামিয়ে যানবাহনের চলাচল বন্ধ রাখার জন্য পাহারাদার নিয়োগ।

রেললাইনের ওপর উড়ালপথ নির্মাণের বিষয়ে এক যুগের বেশি সময় ধরে আলোচনা চলছে। সওজ অল্প কিছু মহাসড়কের উড়ালসড়ক নির্মাণ করেছে। অন্যগুলোতেকে উড়ালসড়ক নির্মাণ করবে—সেটাই ঠিক করতে পারছে না সংস্থাগুলো। পাহারাদার কিংবা যানবাহন আটকানোর কোনো ব্যবস্থাও অন্য সংস্থা করছে না। রেলের নিজস্ব কিছু ক্রসিংয়ে পাহারাদার থাকলেও তাদের বেশির ভাগই অস্থায়ী।

জরুরি ভিত্তিতে প্রায় ৩৫০টি লেভেলক্রসিং সুরক্ষিত করার একটি প্রস্তাব বছর কয়েক আগে উচ্চমহলে পাঠানো হয়। ওই প্রস্তাবে রেল ক্রসিংগুলো অরক্ষিত হওয়ার চারটি কারণ নির্ণয় করা হয়েছে।

সেগুলি হলো—এক. লেভেল ক্রসিং সুরক্ষা করতে সমন্বিত কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। দুই. গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) আওতায় গ্রামীণ সড়ক পাকা হওয়ায় যানবাহনের সংখ্যা ও গতি দুই বেড়েছে। কি পরিমাণ সড়ক ও কত যানবাহন বাড়ল তার প্রকৃত হিসাব রেল কর্তৃপেক্ষের কাছে নেই।

তিন. রেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা বেড়েছে। চার. রেল গেট সুরক্ষার ব্যয় সঙ্কুলান করতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে রেল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধে ওই এলাকায় কাজ করে এমন কোন বেসরকারি সংস্থা অথবা গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ নিজেদের উদ্যোগে গেটম্যান রাখে।

এবিষয়ে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে তারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

গেটম্যান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গড়িমসি
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের সাবেক এক মহাপরিচালক জানান, বর্তমানে ১৪০০ বৈধ রেলক্রসিংয়ের মধ্যে ৬০০ রেলগেট অরক্ষিত। অর্থাৎ বৈধর মধ্যেও অবৈধ। প্রতিটি রেলগেটে অন্তত ৪ জন গেটম্যান প্রয়োজন পড়ে। ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত রেলে খালাসি, চৌকিদার, গেটম্যান কোনো পদেই নিয়োগ হয়নি। ২০০৭ সালের পর পাঁচ থেকে ছয় হাজার লোক নিয়োগ করা হয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। লোকবলের প্রয়োজন কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গড়িমসি করে প্রত্যেকটা রেলগেটকে অরক্ষিত করে রাখা হয়েছে।

রেলের এই সাবেক মহাপরিচালক বলেন, ‘অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী রেলে জনবল দরকার ছিলো চল্লিশ হাজার। আর সেখানে লোকবল আছে ২৬ হাজারের মতো। তবে কিছুদিন আগে দুটো রিক্রুমেন্টের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। ফলে কিছু জনবল সংযুক্ত হবো। রেল কর্তৃপক্ষের উচিৎ যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে সুব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা।’

শেয়ার করুন