২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
আজকের সিলেট ডেস্ক : জাতীয় পার্টিতে দেবর-ভাবীর অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এবং দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের (জিএম কাদের) মধ্যে গৃহবিবাদ এখন তুঙ্গে।
সম্প্রতি জিএম কাদেরকে ‘আদেশ-নির্দেশ’ দিয়ে অব্যাহতি দেওয়া নেতাদের দলে ফেরানো বিষয়ক রওশনের চিঠি নিয়ে বিরোধ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এই বিরোধ-বিবাদ যে অনেকদূর গড়াবে তা রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠদের কথাবার্তাও প্রকাশ পাচ্ছে।
তারা জানান, যারা রওশনের বিরোধিতা করছেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। নভেম্বর রওশনের নেতৃত্বে বিশেষ কাউন্সিল করার কথাও জানান তারা।
অপরদিকে, জিএম কাদের ও দলের সিনিয়র নেতাদের অনেকেই বলেছেন, রওশন এরশাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় জিম্মি হয়ে আছেন জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতার হাতে। তাদের সংগঠন বিরোধী কর্মকান্ডকে ভালো চোখে দেখছে না দল। তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে অব্যাহতিও দেয়া হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
রওশনপন্থীরা বলছেন, এ চিঠি রওশন এরশাদের নির্দেশে প্রস্তুত করা হয় এবং তিনিই স্বাক্ষর করেন। আর জিএম কাদের পন্থীরা রওশনের চিঠিকে অবিশ্বাস করছেন। তারা বলছেন, রওশনকে জিম্মি করে ব্যাংককে বসে এসব করা হচ্ছে। এ অবস্থায় কয়েকজন নেতাকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে বলেও আভাস দিয়েছেন দলের একাধিক নেতা।
এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টির সভাপতিমন্ডলীর সাবেক সদস্য কাজী মামুনুর রশিদ অসুস্থ রওশন এরশাদের সাথে ব্যাংককে ছিলেন। দুদিন আগে দেশে ফিরেছেন।
তিনি বলেন, ‘রওশন এরশাদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তিনি অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশে ফিরবেন।
তিনি আরও বলেন, যারা রওশন এরশাদের পাঠানো চিঠি ও বিবৃতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে এরশাদ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বাজে কথা বলছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন রওশন এরশাদ।’
রওশনের চিঠি নিয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর সন্দেহ প্রকাশ বিষয়ে কাজী মামুনুর রশিদ বলেন, ‘চুন্নু কে, সে এরশাদ পরিবারের বিষয়ে কথা বলার কে। এসব তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বলছে। তারা এত কথা বলছে, কিন্তু ১১ মাস ধরে রওশন এরশাদ অসুস্থ, তারা দেখতে আসেনি কেন? রওশন এরশাদ ঢাকায়ও তাদের ডেকেছিলেন, কিন্তু তারা আসেননি কেন?’
মামুনুর আরও জানিয়েছেন, রওশন এরশাদের ঘোষণা অনুযায়ী আগামি ২৪ নভেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। ওই কাউন্সিলে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে।
রওশনের ডাকা কাউন্সিল ও চিঠি নিয়ে সন্দেহ পোষণকারীদের বিরুদ্ধে রওশনের ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমার কোনো কমেন্ট নেই।’
এর আগে বৃহষ্পতিবার রওশনের চিঠির বিষয়ে মুজিবল হক চুন্নু বলেন, জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ পার্টির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় কিছু করছেন বলে বিশ্বাস করি না। তবে রওশন এরশাদ তার ছেলে সাদ এরশাদ ও আরো দু’এক জনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। বেগম রওশন এরশাদের যে চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সেই চিঠি আমরা আমলেই নিচ্ছি না।
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাঁকে সম্প্রতি দলের সব পদপদবি থেকে অব্যাহতি দেয়া এবং পরবর্তীতে দলীয় চেয়ারম্যানের বিরোধীতা করে রাঙ্গাঁর সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জাপার ভেতরের অন্তর্দাহ-কলহ প্রকাশ্য রূপ নেয়। রাঙ্গাঁর পর অব্যাহতি দেওয়া হয় অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধাকে। এছাড়া রওশন এরশাদের বদলে জিএম কাদেরকে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর দলীয় সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে গত এক মাস ধরে বিদেশে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদের নামে বিভিন্ন বিবৃতি বা চিঠিপত্র আসায় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে রওশন ও জিএম কাদের শিবিরের দূরত্ব।
তবে রওশন এরশাদ এসব বিবৃতি স্বেচ্ছায় দিচ্ছেন না বলে মনে করছেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তিনি বলেন, ‘রওশন এরশাদ অসুস্থ। তার চিকিৎসা চলছে। অসুস্থতা ও বয়স সবকিছু মিলিয়ে ঠিকভাবে বাছবিচার করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থানে তিনি নেই। কোথায়, কী কাগজে স্বাক্ষর করছেন সেটিও হয়তো তিনি বুঝতে পারছেন না।’ সেই সুযোগে একটি চক্র নিজেদের মতো করে সাজানো চিঠিতে তার স্বাক্ষর নিচ্ছেন বলেও মনে করেন তিনি।
সম্প্রতি রওশন এরশাদের নামে যে বিবৃতি আসছে, তাতে স্বাক্ষরকারী সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব ও রওশনের ডাকা জাতীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব গোলাম মসীহ্ বলেন, রওশন এরশাদ নিজেই ওইসব চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। তিনি নিজেই এসব চিঠি প্রস্তুত করতেও বলেছেন। তিনি চিঠিতে স্বাক্ষর করছেন এমন ভিডিও রয়েছে। তাকে কেউ জিম্মি করেনি।
যদিও রওশনের নামে পাঠানো বিবৃতি নিয়ে সন্দেহ দূর করতে প্রমাণ স্বরূপ বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের প্রেস উইং থেকে একটি ছবিও পাঠানো হয়েছে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে। যাতে দেখা যায়, হাসপাতালের বেডে রওশন এরশাদ কাগজপত্র পড়ছেন এবং কলম হাতে স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রওশন এরশাদ টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে-বিদেশে চিকিৎসাধীন।
রওশনের ফোন না ধরা নিয়ে গোলাম মসীহ বলেন, ‘কেউ যোগাযোগই করছে না। তিনি সবার ফোন ধরেন।’ গোলাম মসীহ্র এ মন্তব্যের পর এ প্রতিবেদক একাধিকবার রওশন এরশাদকে ফোন করেছেন। তবে মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।
অবশ্য জিএম কাদেরের অনুসারীদের দাবি, রওশন এরশাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় জিম্মি হয়ে রয়েছেন জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতার হাতে। এমনকি রওশন এরশাদের মোবাইল ফোনটিও আরেকজনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। রওশনকে সারক্ষণ পাহাড়া দেওয়া হচ্ছে, যেন তিনি ব্যক্তিগতভাবে কাউকে কিছু না বলতে পারেন। তারা রওশনের নামে প্রকাশ হওয়া বিবৃতিগুলো অবিশ^াস করছেন। সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করছেন বিবৃতির সত্যতা নিয়ে।
তবে এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান মামুনর রশিদ এর প্রতিবাদ করে বলেন, ‘যারা সন্দেহ করছে, তাদের জন্ম নিয়েও সন্দেহ আছে। রওশন এরশাদ নিজেই দলকে সুসংগঠিত করতে এসব বিবৃতি, চিঠি দিয়েছেন।’
এ বিষয়ে জিএম কাদের বলেন, ‘রওশন এরশাদ অসুস্থ। চিকিৎসা চলছে। সবকিছু মিলিয়ে ঠিকভাবে বাছবিচার করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থানে তিনি নেই।’ এই সুযোগে একটি চক্র নিজেদের মতো করে কিছু একটা লিখে নিয়ে তার স্বাক্ষর নিচ্ছেন বলে মনে করছেন তিনি।
গত একমাস ধরেই বিবৃতিতে সরব দেখা গেছে রওশন এরশাদকে। সবশেষ ২১ সেপ্টেম্বর রওশনের নামে গোলাম মসীহ্ স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জাপা থেকে অব্যাহতি, বহিষ্কার এবং কমিটি থেকে বাদ দেওয়া সবাইকে দলে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে ‘আদেশ’ দিয়েছেন জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জি এম কাদেরের কাছে পাঠানো নির্দেশনামূলক এক চিঠিতে তিনি এ আদেশ দেন। চিঠিতে জাপার গঠনতন্ত্রের ২০ ধারার কয়েকটি উপধারাকে ‘গণতন্ত্রপরিপন্থী ও স্বেচ্ছাচারমূলক’ আখ্যা দিয়ে সেগুলো স্থগিতেরও ‘নির্দেশ’দেন রওশন।
যেসব নেতাকে দলে ফিরিয়ে নিতে রওশন বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন তারা হলেন, সদ্য অব্যাহতি পাওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান (রাঙ্গা) ও সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা, এর আগে দল থেকে বাদ পড়া সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল গাফফার বিশ্বাস, এম এ সাত্তার, দেলোয়ার হোসেন খান, জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, কাজী মামুনুর রশিদ ও ইকবাল হোসেন, সাবেক উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম, ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ও নুরুল ইসলাম নুরু।
বিজ্ঞপ্তিতে রওশন এরশাদ বলেন, ‘এঁদেরসহ দেশজুড়ে অব্যাহতিপ্রাপ্ত, বহিষ্কার ও নিষ্ক্রিয় করে রাখা সব নেতা-কর্মীকে এই আদেশ জারির পর হতে যার যার আগের পদ-পদবিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলো।’