১ অক্টোবর ২০২২


আসুন, প্রবীণের পাশে দাঁড়াই

শেয়ার করুন

বেলাল আহমদ চৌধুরী : কেশে আমার পাক ধরেছে বটে/ তাহার পানে নজর এত কেন?/ পাড়ার যত ছেলে এবং বুড়ো/ সবার আমি এক বয়সি জেনো।’ ‘ক্ষণিকায়’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এমনই বলেছেন, বয়সে প্রবীণ হলেও মনে নবীন মনবাসনা কবির।

বার্ধক্য মানুষের জীবনে একটা স্বাভাবিক পরিণতি। বার্ধক্যের সংজ্ঞা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে শারীরিক, মানসিক, আচরণগত ও সামাজিক দিক বিবেচনায় জরা বিজ্ঞানীরা মূলত: বয়সের মাপকাঠিতে বার্ধক্যকে চিহ্নিত করেছেন। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশ সমূহে ৬৫ বছর বয়সী ব্যক্তিদের প্রবীণ হিসাবে বিবেচনা করা হলেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং জাতিসংঘ ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে ৬০ বছর এবং তদুর্ধ বয়সী ব্যক্তিদেরকে প্রবীণ বলে অভিহিত করা হয়।

বাংলাদেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের প্রধান সমস্যাবলীর মধ্যে অন্যতম সমস্যা আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা। আমাদের দেশের সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে পরিবার হল একটি বুনিয়াদী প্রতিষ্ঠান। প্রবীণরা যৌথ পরিবারের সকলের নিকট হতে সেবা এবং সহায়তা পেতেন এবং এভাবেই শ্রদ্ধা, আদর আর সোহাগে প্রবীণদের দিন কাটত। পরিবার ও সমাজে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন সহ তাদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়ার একটি মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতিক চর্চা ছিল। কিন্তু আজকাল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক টানাপোড়নে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে পড়ছে। ফলে প্রবীণরা হারাচ্ছেন তাদের প্রতি সহানুভূতি পক্ষান্তরে বাড়ছে অবহেলা আর তারা শিকার হচ্ছেন বঞ্চনার। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ধারায় দেখা যাচ্ছে প্রবীণরা প্রথমত: নিজ পরিবারেই তাদের ক্ষমতা ও সম্মান হারাচ্ছেন এবং ধীরে ধীরে সমাজের সকল কর্মকান্ড থেকে বাদ পড়ছেন। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের প্রবীণদের বার্ধক্যজনিত সমস্যা আর অন্যদিকে চরম আর্থিক দীনতার মধ্যে থাকার কারণে তারা পরিবার হতে শুরু করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সকল ধরনের সেবা পাবার সুযোগ হতে বঞ্চিত হচ্ছেন ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছেন যা আগামীতে প্রকটতর জাতীয় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত হবে।
একজন মানুষ যখন বৃদ্ধ হন, কর্মক্ষেত্র থেকে অবসরে যান তখন নানা রোগব্যাধি তাকে কাবু করে ফেলে। কখনো বা তিনি একাকী হয়ে পড়েন। সে সময় বয়স জনিত পরিবর্তন আর প্রজন্ম ব্যবধানের কারণে তার চারপাশের ধারণার জগৎ সন্তানদের চেয়ে খানিকটা আলাদাই থাকে। হয়তো তিনি একই কথা বার বার বলে থাকেন বা তুচ্ছ জিনিস নিয়া উৎকন্ঠিত হন। বাৎসল্যবোধের প্রবল্য কিন্তু তার কমে না। সন্তানের মঙ্গল কামনায় তিনি সব সময়ই সচেষ্ট। সন্তানরা অনেক সময় তার মনের ভাষা বুঝতে পারে না। ভুল বুঝে তারপর বিরক্ত হয়। কখনো বন্ধু-বান্ধবদের সামনে বৃদ্ধ মাতা-পিতার আচরণে বিব্রতবোধ করেন এবং তাদেরকে সবার সামনে আসতে নিরুৎসাহিত করে থাকেন।
বৃদ্ধ বয়সে মাতা-পিতা কেউ কেউ ডিমেনসিয়া বা আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হন। তাতে স্মৃতিশক্তি কমে যায়। আবেগ, অনুভূতি বিবেচনাবোধ কাজ করার ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনটা সন্তানেরা সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। সেখান থেকেই বিরক্তি, আর বিরক্তি থেকে অনাকাক্সিক্ষত কর্কশ আচরণ। তবে শুধু বোঝার ভুল থেকেই নয়, অনেক সময় কোনো কোনো সন্তান বৃদ্ধ বাবা-মাকে পরিবারের বোঝা মনে করে। বাবা-মায়ের চিকিৎসায় অবহেলা থেকে শুরু করে তাঁদের সঙ্গে ঝাঁজালো স্বরে কথা বলে এমনকি কখনো তাদেরকে শারীরিকভাবে পীড়নের ঘটনা ঘটে।
দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য সেবার উন্নতি হয়েছে ফলে মানুষ দীর্ঘায়ু হচ্ছে। এতে বাড়ছে প্রবীণ নারী-পুরুষের সংখ্যা। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রবীণের সংখ্যা দাঁড়াবে মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশেরও বেশি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রবীণদের অবস্থার উন্নতি করতে পারে।
আধুনিক যুগে প্রবীণদের অবসর জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হচ্ছে একাকীত্ব। এই একাকীত্ব যতোটা না বাহিরের তার চেয়ে বেশি ভিতরের জগতে। পরিবারের অনেকের অসহযোগিতা প্রবীণদের মনে পীড়া দেয়। একজন প্রবীণ মানুষ কি বলতে চান? কী দেখতে চান? কী শুনতে চান? কেউ কি তাঁর খোঁজ রাখে? অথচ এই প্রবীণের হাত ধরেই সবাই সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে শৈশব, কৈশোর ও যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হন। জীবন সায়াহ্নে এসে স্মৃতি রোমোন্থন করা বড়ই কঠিন- বেদনাবিধুর। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতায় এমনি এক অসহায়ত্বের কথা লিখেছেন-
প্রথম দিনের সূর্য/ প্রশ্ন করেছিল/ সত্তার নূতন আবির্ভাবে/ কে তুমি?/ মেলেনি উত্তর/ বৎসর বৎসর চলে গেল।/ দিবসের শেষ সূর্য/ শেষ প্রশ্ন উচ্ছারিল/ পশ্চিম সাগর তীরে/ নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়/ কে তুমি?/ পেল না উত্তর-
কী উত্তর দিবেন ফুরিয়ে যাওয়া সত্তাটি। নিস্তব্ধ সন্ধ্যার ওপারে কি আছে? আমাদের সমাজে প্রবীণ নারী-পুরুষ উভয়ই অনেক ক্ষেত্রে পরিবারে উপেক্ষিত হয়ে থাকেন। বার্ধক্যের ক্রান্তিকালে বঞ্চনার চাপা নিশ্বাস আর বেদনার অশ্রু ঝর ঝর কেউ দেখে না। প্রকৃতির চিরায়িত নিয়মে মানুষ একসময় তাঁর সকল সৌন্দর্য হারিয়ে যৌবনের সোনালী ও সুখময় দিনগুলির কথা স্মরণ করে হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। বস্তুত স্রষ্টার সবকিছুই একে অপরের পরিপূরক। প্রবীণদের বোঝা না ভেবে আশীর্বাদ ভাবা উচিত। প্রবীণদের শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানালে পরিবারের শান্তি ও সুখের স্বর্গ রচনা করা যাবে।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে প্রবীন নারী-পুরুষের মধ্যে ‘বৈষম্য’ করা যাবে না। প্রতিটি নাগরিকের যে সব মৌলিক অধিকার রয়েছে সে সব বাস্তবায়নে সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। প্রবীণ নর-নারী উভয়ই যাতে পরিবারে সম্মানজনক জীবন কাটাতে সক্ষম হন সেই জন্য প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ নেয়া। সমাজের করণীয় হলো, সমাজকে সব প্রবীণদের মৌলিক স্বাধীনতা, মানবাধিকারের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, প্রবীণদের দারিদ্র্য দূরীকরণে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে অর্থাৎ প্রবীণদের অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা সর্বাগ্রে নিতে হবে। পরিশেষে লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কথায় বলতে হয়- যৌবন। যৌবন বড় ক্ষণস্থায়ী। বিজলীর ঝিলিকের মতো, মেঘলা দিনের রোদদূরের মতো। বার্ধক্য সেই তুলনায় দীর্ঘতর।

(লেখক: কলামিস্ট।)

শেয়ার করুন