২৪ ডিসেম্বর ২০২২
আজকের সিলেট ডেস্ক : দুই যুগেরও বেশি সময় পর জোটহীন বিএনপি। ১০ ডিসেম্বরের বিএনপির গণসমাবেশের আগে হঠাৎ করেই ২০ দলীয় জোট বিলুপ্তির ঘোষণায় ইতিমধ্যে শরিকরা দুটি প্লাটফর্মে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জোটের শরিকরা আক্ষেপ করে বলছেন, নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই ক্ষমতায় বিভোর হয়ে নতুন নতুন রাজনৈতিক ঐক্য, মঞ্চ ও মোর্চা তৈরি করে। আর বেমালুম ভুলে যায় আমাদের রাজপথের শ্রমের কথা। বিলুপ্ত হওয়া জোটে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে কয়েকবছর যাবতই দূরে রেখেছে বিএনপি।
জোটের শরিকরা বলছেন, সারাবছর বিএনপির সঙ্গে থেকে রাজপথে সংগ্রামে থাকি আমরা, অথচ নির্বাচন সন্নিকটে এলেই বিভিন্ন নামে নতুন জোট তৈরি করে আমাদেরকে অবহেলিত রাখা হয়। বিএনপির দুর্দিনে তাদের দেওয়া কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। হঠাৎ করেই জোট বিলুপ্তির ঘোষণায় হতাশ হয়েছেন জোট নেতারা। কোনো কোনো জোট নেতা এ বিষয়ে বিএনপির সমালোচনা করে ঢাকাটাইমসকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
জোটের এক নেতা বলেন, ১৯৯৭ সাল থেকেই জোটের শরিকদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসছে। বিগত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ২০ দলীয় জোটকে নিষ্ক্রিয় রাখে বিএনপি। এবারও গণতন্ত্র মঞ্চসহ বিভিন্ন জোটের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের কথা বলে দীর্ঘবছরের জোট বিলুপ্তি করলো, বিলুপ্ত করার আগে একবারও আমাদেরকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না বিএনপি।
১৯৯৭ সালে বিএনপি, জামায়াত ইসলামী, জাতীয় পার্টি (জা-মো), জাগপা, পিএনপি, এনডিএ এবং ডেমোক্রেটিক লীগ সমন্বয়ে সাত দলীয় জোট গঠনের মাধ্যমে জোট রাজনীতি শুরু করে বিএনপি। এই জোট তাৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অসংখ্য সভাসমাবেশ করে। ১৯৯৮ সালে এই সাত দলীয় জোট পার্বত্য শান্তি চুক্তির প্রতিবাদে রাজধানী থেকে খাগড়াছড়িতে লংমার্চও করে।
পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের আগে এই সাতদলীয় জোট বিলুপ্ত করে ১৯৯৯ সালে বিএনপি, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, অবিভক্ত ইসলামি ঐক্যজোট নিয়ে গঠন করা হয় চারদলীয় জোট। অবহেলিত হয়ে পড়ে সাতদলীয় জোট। পরে নির্বাচনের কিছুদিন আগে এরশাদ চার দলীয় জোট ত্যাগ করলে জাপার তৎকালীন মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জুসহ একটি অংশ রয়ে যায় এ জোটে। পরে এ জোট ক্ষমতায় এলে চারদলীয় জোট সরকার নামেই প্রতিষ্ঠা পায় বিএনপির শাসনামল।
জোটের এক শরিকদলের নেতা অভিযোগ করে বলেন, এই শাসনামলে মূল্যায়ন পাননি সাতদলীয় জোটের অন্যতম রূপকার ভাষাসৈনিক অলি আহাদ, আনোয়ার জাহিদ, শফিউল আলম প্রধান, শওকত হোসেন নিলু, এএসএম সোলাইমান। এ কারণে প্রধানের জাগপা এবং নিলুর পিএনপি নিজ দল বিলুপ্ত করে যোগ দেন এরশাদের জাতীয় পার্টিতে।
ডেমোক্রেটিক লীগ (ডিএল) সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনি আক্ষেপ করে বলেন, ১৯৮২ সাল থেকে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থেকে দুটি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছি। সাতদলীয় জোট গঠন হলো, জেলে গেলাম কয়েকবার। কিন্তু বিএনপি শরিকদের মূল্যায়ন করেনি। যে অলি আহাদ সাতদলীয় জোটের রূপকার ছিলেন সেই অলি আহাদকেও তারা লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে।
সাইফুদ্দিন মনি বলেন, আমরা অক্ষরে অক্ষরে বিএনপির কথা পালন করেছি। আমরা ক্ষমতাসীন দলের জোটে যাওয়ার প্রস্তাব পেলেও যাইনি। আমরা জানি বিএনপি আবারও ক্ষমতায় এলে আমরা মূল্যায়ন পাবো না, তবু বিএনপির সঙ্গে ছিলাম, আছি এবং থাকবো।
২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর চারদলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে ব্যস্ত ছিল। বাতিল হয়ে যায় তাদের নিবন্ধন। আরেক শরিক ইসলামি ঐক্যজোট কয়েকটিভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে ক্ষমতার ভাগ পাওয়া চারদলীয় জোট।
পরবর্তীতে চারদলকে সঙ্গে রেখেই ২০১২ সালে গঠিত হয় ১৮ দলীয় জোট। পরে জাপা (জাফর) এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলকে নিয়ে করা হয় ২০দলীয় জোট। এরপর থেকে পথচলা এই জোটের। এ জোট নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বয়কট করে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে বিএনপি গঠন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এ ফ্রন্ট গঠিত হলে গুরুত্বহীন হয়ে যায় ২০দলীয় জোট। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এই অভিমানে বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি এবং এনডিপির মূল নেতারা জোট ত্যাগ করেন। পরে অবশ্য ত্যাগ করা জোটের একাংশ নেতাদের জোট জিইয়ে রাখে বিএনপি।
এবারও আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে একাধিক রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ৮ আগষ্ট আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে নাগরিক ঐক্য, সাইফুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বে গণসংহতি আন্দোলন, ড. রেজা কিবরিয়ার নেতৃত্বে গণ অধিকার পরিষদ, রফিকুল ইসলাম বাবলুর নেতৃত্বে ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও হাসনাত কাইয়ুমের নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন এই দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয় গণতন্ত্র মঞ্চ।
এবারও বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়া দলগুলোকে প্রধান্য দিতে গিয়ে বিলুপ্ত করা হয় দুই দশকের রাজপথে বিএনপির পাশে থাকা ২০দলীয় জোট। তাই কোনো কূলকিনারা না পেয়ে ২২ ডিসেম্বর নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে জোটের ১২টি দল একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম আত্মপ্রকাশ করে। জোটের বাকী দলগুলোও আলাদা রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি করতে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন এক শরিক নেতা।
জোট নেতাদের মূল্যায়ন না করা প্রসঙ্গে ন্যাপ মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূইয়া বলেন, বিএনপিকে জোটের রাজনীতিতে আনার জন্য যে মানুষটি সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছে সেই ভাষা সৈনিক অলি আহাদের প্রতি সবচেয়ে বেশি অবিচার করেছে বিএনপি। চারদলীয় জোট যখন ক্ষমতায় তখন অলি আহাদকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা না করলেও তারেক রহমান নির্মল সেনকে চিকিৎসার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
গোলাম মোস্তফা ভূইয়া বলেন, বিএনপি ক্ষমতার স্বার্থে দীর্ঘদিনের সাথীদের ফেলে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। তারা নতুন কাউকে পেয়ে পুরোনো পরিক্ষিত সঙ্গীদের অবদানের কথা বেমালুম ভুলে যায়, এটা তাদের পুরোনো ইতিহাস। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা গণতন্ত্র মঞ্চ কি জাতীয়তাবাদী আদর্শ বিরোধীজোট কিনা প্রশ্ন রাখেন গোলাম মোস্তফা ভূইয়া।
জোট বিলুপ্তি প্রসঙ্গে এলডিপি চেয়ারম্যান কর্ণেল অব. অলি আহমেদ বলেন, ২০১৪ বা ১৮ সালে জোট ভাঙা হয়নি। জোট আদৌ বিলুপ্ত করেছে কিনা তাও জানি না, আমার সঙ্গে আলোচনাও হয়নি। শুধুমাত্র ২৭ দফা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঐক্যমতও হয়েছি। তবে, বিএনপি বলেছিলো যুগপৎ আন্দোলন করলে ভালো হবে। জোটের কিছু শরিক আলাদা জোট করেছে, হয়ত তারা বিছিন্ন না থেকে একটি প্লাটফর্মে রাজপথে থাকবে। তবে, আমরা এককভাবেই রাজপথে থাকবো। কারণ, আমাদের স্বক্ষমতা আছে।
অলি আহমেদ বলেন, দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান আর জনগণের নেই। এগুলো আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। যতদিন প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের প্রতিষ্ঠান হবে না ততদিন দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন করতে হলে জনগণের অধিকার থাকতে হবে। দেশকে ন্যায় ও নীতির ওপর দাঁড় করাতে হবে। পুরো দেশ আজ দুর্নীতিগ্রস্ত।