১০ জানুয়ারি ২০২৩
ড. মোঃ জয়নুল আবেদীন রোজ : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বৃটেন এবং ইন্ডিয়া হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এই দিনটি প্রতিবছর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাত্রে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মমভাবে গুলি বর্ষন করা হয় এবং সে রাতেই বঙ্গবন্ধুকে আটক করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন কারাগারে প্রায় সাড়ে নয় মাস আটক থাকার পর স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে তারা মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়। তারা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারের মধ্যে হত্যা করে ফেলতে কিন্তু তারা যখন দেখলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলে তাদের নানামুখী আন্তর্জাতিক চাপ সামলাতে হবে, বিশেষ করে ইন্ডিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বিশ্ব মোড়লদের চাপ দিতে থাকেন। পাকিস্তানের অবৈধ সরকার বুঝতে পেরেছিলো বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ মানেই শেখ মুজিব। তাই তারা বারবার বারবার জেলখানায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেও সাময়িকভাবে বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে সুযোগের কিন্তু বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা তাদের সেই সুযোগ দেয়নি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের সকল ষড়যন্ত্র, সকল অত্যাচারের তীব্র জবাব দিয়ে নয় মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে, ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদানের মাধ্যমে, ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্নের সোনার বাংলা স্বাধীন হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশে ফিরে আসেন! তাঁরই সোনার বাংলাদেশ ধন্য হয় সন্তানকে বুকে ফিরে পেয়ে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে চোখের জলে ভাসতে থাকা স্ত্রী, সন্তানদের ললাটে একে একে চুম্বন করে বিদায় নেন শেখ মুজিব। ধরে নেওয়া হয়েছিলো এটিই তার শেষ বিদায়। স্ত্রী, পুত্র-কন্যারাও ভাবতে পারেননি তিনি তাদের মাঝে আর কোনোদিন ফিরে আসবেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিঠে গুঁতোতে গুঁতোতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে জিপের কাছে নিয়ে আসে। নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানের কারাগারের।
বাঙালি জাতির তীব্র প্রচেষ্টায় এবং ভাগ্যের সুপ্রসন্নতায় নয় মাসে দেশ স্বাধীন হয় এবং তিনি বিশ্ব মানচিত্রে নতুন এক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কাঙ্খিত নেতৃত্বে আরোহণ করেন। ১০ মাস আগে তাকে আটককারী ইয়াহিয়া খানের ঢাকার সরকারি বাসভবনের পালঙ্কে হেলান দিয়ে সেদিন কয়েকটি মার্কিন পত্রিকার সাংবাদিকের সঙ্গে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। শক্তহাতে দেশের হাল ধরে ভেঙেপড়া অর্থনীতিতে পুনরায় সচল করার তীব্র নেশায় তাঁকে পেয়ে বসে। আর হবেই না বা কেন! যে দেশের মানুষের মুক্তির দাবিতে জীবনের অর্ধেক, যৌবনের প্রায় পুরোটাই জেলে কাটিয়েছেন সে দেশের মানুষের কষ্ট দূর করার সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করতে থাকেন। অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে বজ্র কন্ঠে হুংকার ছাড়েন। কিন্তু পাকিস্তানীদের এজেন্টরা এটা সহ্য করতে পারে না। তারা নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু করে আর পাকিস্তানীরা দিতে থাকে ইন্ধন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। রেহাই পায়না শিশু রাসেল সহ গর্ভবতী নারী এবং বৃদ্ধা মহিলারাও। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলতুন্নেছা মুজিব ছাড়াও তাদের পরিবারের সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর নিকট আত্মীয় সহ মোট ২৬ জন সেদিন শহীদ হন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় পশ্চিম জার্মানীতে অবস্থান করার কারণে তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু পুত্র শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্ণেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক, প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্ত:সত্তা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খানকে তারা হত্যা করে।
বাঙালির কি প্রবল আগ্রহ উদ্দীপনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। সেই দেশেরই কুলাঙ্গারদের নির্মমতায় এবং বিশ্বাসঘাতকতায় জাতি হারালো শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়লো কয়েক যুগের জন্য। এরপর শুরু হল অবৈধ সরকার গঠন, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনদেরকে জেলখানায় হত্যা করা। জাতীয় চার নেতাকে তারা জেলখানায় হত্যা করে এবং হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্নভাবে হত্যা করে এবং জেলখানায় বন্দি করে রাখে। পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থ রক্ষার্থে তারা বাংলাদেশকে পক্ষান্তরে পাকিস্তানের একটি করিডর করে তোলে। মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার পক্ষের মানুষজন হতে থাকে লাঞ্ছিত। এভাবে চলতে থাকে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বিদেশী প্রভুদের খুশির মাধ্যমে মসনদে বসে থাকার ষড়যন্ত্র। কিন্তু আল্লাহর কি অশেষ মেহেরবানি ১৯৯৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসেন এবং দেশকে ঢেলে সাজানোর কাজে মনোনিবেশ করেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে নিরলস ভাবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু পাঁচ বছরের মাথায় পুনরায় নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে- বিশেষ করে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া হয়ে যাবে, মসজিদে উলু ধ্বনি বাজবে ইত্যাদি ইত্যাদি মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ধর্মপ্রাণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে এবং বড় ধরনের ষড়যন্ত্র করে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে পরপর তিনবার বাংলাদেশকে বিশ্বের মধ্যে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করে বিশ্বের কাছে এদেশকে লাঞ্ছিত ও কলঙ্কিত করেছিলো। জনগণের বুঝতে আর বাকি ছিল না কে সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়তে পারবেন। তাই তারা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য তীব্র প্রতীক্ষা করতে থাকে কিন্তু তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে জেলখানায় বন্দি করে এবং দেশ পরিচালনা করতে থাকে। কিন্তু জনগণের তীব্র চাপে তারা টিকতে না পেরে নির্বাচন দেয় এবং নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয় এবং দেশকে ঢেলে সাজাতে শুরু করে। এর পরের ইতিহাস শুধু সাফল্যের ইতিহাস! জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন একটি ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ, বিশ্ববাসীর কাছে একটি রোলমডেল। এদেশের অর্জন দেখে বিশ্বের মানুষ অবাক হয়ে যায়, কি করে একটি তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ ফলে-ফুলে-ফসলে ভরপুর হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লেখাতে পারে! জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে, পরিবর্তন এসেছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থায়, কৃষিতে, শিক্ষা ব্যবস্থায়, স্বাস্থ্য খাতে, আবাসনে, শিল্প ক্ষেত্রে, উন্নয়ন ঘটেছে সর্বক্ষেত্রে।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আমাদের জন্য হোক নতুন উদ্দীপনায় বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথের দিন, ষড়যন্ত্রকারীদের উপযুক্ত জবাব দেওয়ার শপথ।
(লেখক : সভাপতি, যুক্তরাজ্য অনলাইন প্রেসক্লাব।)