২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
আজকের সিলেট ডেস্ক : ডিজিটালা ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে ভূমি ব্যবস্থাপনার পুরনো চিরাচরিত ও সময় সাপেক্ষ সেবাসমূহ। যেসব সেবা পেতে আগে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হতো গ্রাহকদের, এখন তা এসে ধরা দিয়েছে হাতের মুঠোয়। আদ্দিকালের ভূমি ব্যবস্থপনাকে আধুনিক করতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল প্লাটফর্মে যুক্ত হওয়ার কথা জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলছেন এসব সেবা চালু হওয়ার ফলে জনদুর্ভোগ অনেক কমে এসেছে, আগামী দিন তা আরো কমবে।
ক্যাশলেস ভূমি উন্নয়ন কর,ক্যাশলেস ই-নামজারি, আধুনিক নাগরিক সেবাকেন্দ্র ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন, বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে, জমির মালিকানা এবং মৌজা ম্যাপের অনলাইন ভার্সন প্রবর্তন, জমি নিবন্ধনের সাথে স্বয়ংক্রিয় নামজারি, নামজারির সাথে স্বয়ংক্রিয় খতিয়ান ও মৌজা ম্যাপ প্রস্তুত, কলসেন্টার স্থাপন, ভূমি সেবা অ্যাপ, হোল্ডিং ডাটা ম্যানুয়াল থেকে ডিজিটালে রূপান্তরিতকরণসহ ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
ক্যাশলেস ভূমি উন্নয়ন করের সুবিধাভোগী জয়নাল আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, আমার ভোগান্তি অনেক কমে গেছে। এখন আমি ঢাকা থেকেই সব কাজ করতে পারি। অনলাইনে সব কাগজপত্র পেয়ে যাই। এসব কাগজপত্র জমা দেয়াটা ঝামেলার ব্যাপার ছিল।
মানুষের ভোগান্তি লাঘব এবং জটিলতা এড়ানোর জন্য ই-নামজারি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ক্যাশলেস।মই-নামজারি আবেদন ও নোটিশ ফির মত নামজারি অনুমোদনের পর রেকর্ড সংশোধন এবং খতিয়ান সরবরাহ ফিও অনলাইনে নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ই-নামজারি আবেদন ফি (কোর্ট ফি) ২০ টাকা ও নোটিশ ফি (নোটিশ জারি ফি) ৫০ টাকা ই-নামজারি আবেদন করার সময়ই অনলাইনে প্রদান করতে হতো। তবে এতদিন রেকর্ড সংশোধন ফি ১০০০ টাকা ও খতিয়ান সরবরাহ ফি ১০০ টাকা অনলাইনে ও সরাসরি ক্যাশের মাধ্যমে দুই ভাবেই গ্রহণ করা হতো।
গত ১ এপ্রিল ২০২২ হতে সম্পূর্ণভাবে অনলাইনে জমা প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ডিসিআর ও খতিয়ানের কোনো ত্রুটি সংশোধনের জন্য কোনো ফি প্রযোজ্য হবে না। একইভাবে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী দলিলাদি না পাওয়ার জন্য না-মঞ্জুরকৃত কোনো নামজারি আবেদন পুনরায় চালু হলে উক্ত আবেদন মঞ্জুরের পর রেকর্ড সংশোধন ও খতিয়ান সরবরাহ ফি বাবদ মোট ১,১০০ টাকা প্রযোজ্য হবে।
ঢাকার বাসিন্দা আবু সালেহ বিবার্তাকে বলেন, ব্যবস্থাটা খুব সুন্দর হয়েছে। এখন আমি অনেক কিছুই কম্পিউটারের দোকানে গেলে পাই। সবকিছু জানতে পারি। পাশাপাশি সমস্যা তো কিছু আছেই। আস্তে আস্তে সব সমস্যা কেটে যাবে বলে আশা করি।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ভূমি ভবনে পরীক্ষামূলভাবে নাগরিক ভূমিসেবা কেন্দ্র (কাস্টমার সার্ভিস সেন্টার) চালু হয়েছে।১৬১২২ এ কল করে ভূমি সেবা গ্রহণ করার সাথে সাথে নাগরিকগণ ইচ্ছে করলে নাগরিক ভূমিসেবা কেন্দ্রে সরাসরি এসে ভূমি সম্পর্কিত আইনি পরামর্শ এবং বিভিন্ন ধরণের ভূমিসেবা যেমন ই-নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর ইত্যাদি সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। প্রাথমিকভাবে ৯ জন প্রতিনিধির মাধ্যমে এই সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অভিজ্ঞ ভূমি বিশেষজ্ঞ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ ভূমি পরামর্শ প্রদান করবেন।
সেবা প্রদানকারীরা বিবার্তাকে বলেন, আমরা অনেক সাড়া পাচ্ছি। লোকবল কম থাকায় সারাক্ষণ সেবা দিতে পারছি না। তবে যারা সেবা পাচ্ছেন তারা সবাই খুশি। মুঠোয় ভূমিসেবা স্লোগান সামনে রেখে কাজ করে যাওয়া ভূমি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে ইউএন পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছে।
সেবাকে সহজ করতে চালু করা হয়েছে কল সেন্টার। এই সেন্টারে (১৬১২২) কল দিয়ে সেবাপ্রার্থীরা ভূমিসেবা নিতে পারবে ও অভিযোগ জানাতে পারবে। পাশাপাশি ওয়েব সাইটে (land.gov.bd) ভিজিট করেও কাংখিত তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেবাকে আরো সহজ করার জন্য স্যোসাল মিডিয়াতেও প্রচার করা হয় বলে জানান ভূমি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ মো. আব্দুল্লাহ আল নাহিয়ান।
ভূমি সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ৪ কোটির অধিক হোল্ডিং ডাটা ম্যানুয়াল থেকে ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়েছে। ই-রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম-এর সাথে ই-মিউটেশন সিস্টেমের কারিগরি সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। ই-নামজারির সাথে-সাথে হোল্ডিং নম্বরসহ ভূমি উন্নয়ন করও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত হয়ে যাবে। ১৭টি উপজেলায় এর পাইলটিং হয়েছে।
সচিব আরও জানান, সমগ্র বাংলাদেশের ১,৩৮,০০০ ম্যাপকে ডিজিটাইজ করাসহ স্যাটেলাইট ইমেজ ক্রয় করা হচ্ছে। এই ম্যাপের উপরে স্যাটেলাইট ইমেজ বসিয়ে প্লটভিত্তিক জমির শ্রেণির একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি হচ্ছে। ২০২৩ সালের মার্চ নাগাদ ১০ হাজার ডিজিটাল মৌজা ম্যাপ ই-নামজারি সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত হচ্ছে। নামজারির সাথে সাথে এই ডিজিটাল ম্যাপ ও খতিয়ান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধিত হতে থাকবে। ভূমি সেবা অ্যাপ থেকে নাগরিকগণ তাদের জমির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, অবস্থান ও পরিমাপ তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে যাবেন।
সচিব জানান, কল সেন্টার থেকে প্রায় ১০ থেকে ২০ লাখ কল নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বিদেশ থেকে নিষ্পত্তিকৃত কলের সংখ্যা প্রায় ৬০০০। প্রায় ১১,৪০০ ফলো-আপ কল (কল ব্যাক) করা হয়েছে। কল সেন্টার ও ফেসবুকের মাধ্যমে নাগরিকগণকে ২০৮০০ টি ভূমি সংক্রান্ত আইনি পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে।
সচিব আরো জানান, ই-নামজারি সিস্টেমের মাধ্যমে প্রতি মাসে অনলাইনে প্রায় ২ লক্ষাধিক নামজারি নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ক্যাশলেস নামজারি সিস্টেম থেকে অনলাইনে আদায়কৃত প্রায় ১৬০ কোটি টাকা তাৎক্ষণিকভাবে সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে।
ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আগামী পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) থেকে সারা দেশে ক্যাশলেস ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থা চালু করা হবে। এর পর থেকে আর সরাসরি এলডি ট্যাক্স গ্রহণ করা হবে না। ইতোমধ্যে ক্যাশলেস ই-নামজারি ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
নাগরিককে অনলাইনে দাখিলা প্রদান করা হয়েছে প্রায় ৪৫ লক্ষ। অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় হয়েছে ৩৭৫ কোটি টাকা যা তাৎক্ষণিকভাবে অটোমেটেড চালান সিস্টেমের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, ভূমি ভবনে একটি নাগরিক সেবাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে জেলা পর্যায়ে এ সেবা সম্প্রসারণ করা হবে। জেলাভিত্তিক এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে নাগরিক ভূমিসেবা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হবে। এজন্য প্রাইভেট এজেন্টশিপ নীতিমালা করা হচ্ছে। কলসেন্টার ছাড়াও এসব সেবা কেন্দ্রে নাগরিকরা সরাসরি গিয়ে ভূমিসেবা গ্রহণ করতে পারবেন। এছাড়া, প্রাইভেট এজেন্ট কার্যক্রম মনিটরের জন্য সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে এবং উপজেলা ও জেলা ভিত্তিক নাগরিক কমিটি করা হবে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, দুটি প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ডিজিটাল জরিপ হচ্ছে। একটি প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালীতে জরিপ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে মৌজার ডিজিটাল জরিপও সম্পন্ন হয়েছে। অন্য একটি প্রকল্পের আওতায় ৩টি সিটি কর্পোরেশন (চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহী মেট্রোপলিটন), মানিকগঞ্জ পৌরসভা, ধামরাই উপজেলা ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ডিজিটাল সার্ভে হবে।
দেশের ডিজিটাল ল্যান্ড সার্ভের সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, ‘ডিজিটাল সার্ভে সেখানে শুরু করেছি, যেখানে হয়নি। যেমন, বরগুনা, পটুয়াখালী। পটুয়াখালীতে একটা ডিজিটাল সার্ভের জন্য পাইলট প্রজেক্ট করেছি। আমরা আরও দুটো জেলা যুক্ত করেছি- পাবনা ও সিরাজগঞ্জ। ওইগুলো শেষ করার পর আমরা সারাদেশে ডিজিটাল সার্ভের কাজ শুরু করব।’
মন্ত্রী বলেন, বর্তমানে ৫ কোটি ২১ লক্ষের অধিক জমির মালিকানা এবং ৭৫ হাজারের অধিক মৌজা ও ম্যাপের তথ্য অনলাইনে রয়েছে। এ সিস্টেম থেকে প্রায় ১৩ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা সরকারি রাজস্ব আদায় হয়েছে। ডাক বিভাগ এখন নাগরিকের ঠিকানায় খতিয়ান পৌঁছে দিচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩ লক্ষের অধিক খতিয়ান ডাকবিভাগের মাধ্যমে নাগরিকগণ হাতে পেয়েছেন। বিদেশেও এই সেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিনিয়ত নামজারি খতিয়ান যুক্ত হচ্ছে এ সিস্টেমে। কোন খতিয়ান থেকে জমি নামজারি হবার সাথে সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে মূল খতিয়ান হতে ধারাবাহিকভাবে সৃষ্ট নতুন খতিয়ান এর ট্রি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফলে জমি ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আসবে এবং মামলা-মোকদ্দমা কমে যাবে।