২৩ মে ২০২৩


সাংবাদিক এটিএম নূরুল ইসলাম খেজুর: কিছু স্মৃতি কিছু কথা

শেয়ার করুন

মোহাম্মদ আলাউর রহমান ঠাকুর: প্রিয় সাংবাদিক এটিএম নূরুল ইসলাম খেজুর ভাইয়ের চলে যাওয়ার আজ ৮ বছর। তিনি এতো তাড়াতাড়ি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন তা আমরা কেউ ভাবতে ও পারিনি। কিন্তু সবই আল্লাহ-তায়ালার অমোঘ বিধানে আবর্তিত হয়। কেউ আগে, কেউ পরে এভাবেই পৃথিবী থেকে মানুষকে বিদায় নিতে হয়। এই চরম বাস্তবতাকে মেনে নেয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু আছে যা অনেক অনেক দিন ধরে মানুষকে কাঁদায়। মানুষের হৃদয়ে তাঁর স্মৃতি থাকে অমলিন।

নবীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি এটিএম নূরুল ইসলাম খেজুর ভাই ও ছিলেন এমনি একজন মানুষ যাকে আমরা ভুলে যেতে পারিনি। তাঁর মৃত্যুর পনেরো-বিশ দিন পূর্ব থেকে কর্ম ব্যস্ততার কারণে তার সাথে আমার দেখা হচ্ছিলো না। এরই মধ্যে একদিন বাসা থেকে বের হওয়া মাত্রই আমাদের নবীগঞ্জের উদীয়মানা রাজনীতিবিদ চৌধুরী ফয়সল শোয়েব ভাই আমাকে বললেন খেজুরের কী অবস্থা? তার প্রশ্নটা আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাকে বিনয়ের সাথে জানালাম আমি তো কিছুই জানি না। তৎক্ষনাৎ তিনি জানালেন খেজুর ভাই স্ট্রোক করেছেন। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সরাসরি খেজুর ভাইয়ের টেলিটক নাম্বারে ফোন দিলাম। কিন্তু ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কোন জবাব আসলো না। কিছুক্ষণ পর তিনি নিজেই কলব্যাক করলেন। গলার স্বর বসে গেছে। কথাবার্তা খুব কষ্টে বলছেন। বললাম আপনি আর কথা বলবেন না অসুস্থতা বেড়ে যাবে। আগামীকাল সকালেই সিলেটে আপনাকে দেখতে আসবো। খেজুর ভাইকে সিলেটের জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো। পরদিন সকালেই বয়োবৃদ্ধ সাংবাদিক নবীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মছদ্দর আলী সাহেবকে নিয়ে সিলেটে রওয়ানা দিলাম। রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি কেবিনে তার চিকিৎসা চলছে। আমাদেরকে দেখে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না। কন্ঠে জড়তা থাকলে ও বারবার উপস্থিত স্বজনদের বলছেন সভাপতি সাহেব এসেছেন। তিনি আমাকে সভাপতি সাহেব বলেই সম্বোধন করতেন। ২০০৮ সালে আমাকে নবীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল। সেই থেকেই খেজুর ভাইয়ের কাছে আমি সভাপতিই রয়ে গেলাম। বয়সে আমি তার কয়েক বছরের ছোট হলে ও তিনি আমাকে কখনো নাম ধরে ডাকেননি। এটা তার ভদ্রতা সৌজন্যতার এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ । আর এ কারণেই হাজারো মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিতে পেরেছিলেন তিনি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়েই তিনি আমাদের সাথে কথা বলছিলেন। ইতোমধ্যে কর্তব্যরত চিকিৎসক বেশ কয়েকবার তাকে দেখে গিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরীক্ষা-নীরিক্ষার ব্যবস্থাপত্র দিয়ে গেছেন। একপর্যায়ে তার দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে এলো। বিছানা থেকে উঠা তার একার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না। আমি তাকে বিছানা থেকে তুলে ধরে রাখলাম আর ভাবী প্লেট থেকে ভাত নিয়ে আস্তে আস্তে তাকে খাওয়াচ্ছিলেন। এই স্মৃতিটা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। জানা ছিলো না আন্তরিকতা আর ভালবাসা দিয়ে খেজুর ভাইকে পরম মমতায় এভাবে আর কোনদিন ধরতে পারবো না। হাসপাতালে অবস্থানকালে কয়েকজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করলাম। তারা আমাকে আশ্বস্ত করলেন সমস্যা গুরতর নয়। দুই তিন দিন পরেই বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন। বুকভরা আশা নিয়ে মছদ্দর আলী সাহেবসহ খেজুর ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।জানতাম না এটাই হবে তার সাথে আমাদের শেষ বিদায়। দু’দিন পর আমার ঘনিষ্টজন মাওলনা আব্দুল কাদির হোসাইনী সাহেব ফোন করে জানালেন খেজুর ভাই আর বেঁচে নেই। মনটা মুহূর্তেই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না খেজুর ভাই মৃত্যুবরণ করেছেন। নবীগঞ্জ পৌর এলাকার রাজনগর গ্রামে তার বাড়িতে লাশ নিয়ে আসা হলো। সেখানে যাওয়ার পর এক বেদনাবিধূর ও শোকাবহ অবস্থার সৃষ্টি হলো। তার ছোটভাই জাকির (এটিএম জাকিরুল ইসলাম,বর্তমানে ইংরেজি দৈনিক দ্যা ইন্ডিপেনডেন্টের নবীগঞ্জ প্রতিনিধি) আমাকে জড়িয়ে ধরে যেভাবে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলো তা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। আমার চোখ দিয়ে ও তখন অঝোরে পানি পড়ছিলো। নবীগঞ্জ দারুল উলুম মাদরাসা ঈদগাহ ময়দানে বিশাল জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার দু’টি অবুঝ শিশু এতিম হয়ে পড়ে। খেজুর ভাই আজ আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই। কিন্তু তার স্মৃতি আমাদের মধ্যে অমলিন হয়ে রয়েছে। সেই ছোটবেলা থেকেই সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। সাপ্তাহিক স্বাধিকার,দৈনিক খবর, দৈনিক প্রতিদিনের বাণী,খোয়াই, দৈনিক সিলেটের ডাক, দৈনিক যুগভেরী,দৈনিক মুক্তকণ্ঠসহ অনেকে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় তিনি সক্রিয় সাংবাদিকতায় নিয়োজিত ছিলেন। একটা সময় ছিলো খেজুর ভাইকে একনামে সাংবাদিক হিসেবে সবাই চিনতো।

অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে দাপটের সাথে সাংবাদিকতা করেছেন তিনি। তার এ পথ ছিলো কন্টকাকীর্ণ। তারপর ও এ পথ ধরেই তিনি চলেছেন।১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকারের তথ্যমন্ত্রী হয়ে সিরাজুল হোসেন খান নবীগঞ্জ ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে একটি পাবলিক মিটিংয়ে বক্তব্য রাখছিলেন আর খেজুর ভাই অত্যন্ত কাছ থেকে তার বক্তব্য নোট নিচ্ছিলেন। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। আমার তখন মনে হয়েছিলো আমি যদি খেজুর ভাইয়ের মতো সাংবাদিক হতে পারতাম তাহলে তো মন্ত্রী সাহেবের কাছাকাছি বসে নিউজ লিখতে পারতাম। নবীগঞ্জ শহরের আরজু হোটেলের আড্ডাটা আমাদের আর নেই। আড্ডার মধ্যমণি খেজুর ভাই যে বেঁচে নেই। একে একে পরপারে চলে গেছেন ছাত্তার ভাই,কাইয়ুম ভাই, সৈয়দ মোস্তাকিম আলী,আব্দুল হাই আজাদ,দেওয়ান ফেরদৌস, কামরুল হাসান চৌধুরী আলিম,কালীপদ ভট্টাচার্য।এদের সবাইকে নিয়ে আরজু হোটেলে প্রায়শই আমাদের চায়ের আড্ডা হতো।নবীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি, সিনিয়র সাংবাদিক এস আর চৌধুরী সেলিম যিনি এখন সিলেটে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত তিনি ও আমাদের এ চায়ের আসর মাতিয়ে রাখতেন। এতে আরো যোগ দিতেন সিনিয়র সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন,কাজী ওবায়দুল কাদের হেলাল এবং আনোয়ার হোসেন মিঠু ও। ১৯৯৩ সালে নবীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের নির্বাচনে এসআর চৌধুরী সেলিম ভাই সভাপতি ও এটিএম নূরুল ইসলাম খেজুর ভাই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আমি তাদের সাথে ক্রীড়া সম্পাদক ছিলাম। সেই থেকেই তাদের সঙ্গে চলাফেরা উঠা বসা। আমাদের আরেকটি আড্ডার আসর বসতো খেজুর ভাইয়ের কন্টিনেন্টাল কোরিয়ার সার্ভিস অফিসে। আড্ডা দিতে দিতে কখন যে রাত দুইটা হয়ে গেছে তা আমারা বুঝেই উঠতে পারিনি। এরপর নবীগঞ্জ জেকে হাইস্কুল পয়েন্টে জন্টুদার স্টলে চা পর্ব শেষে যার যার বাড়ি ফেরা। আসর মাতিয়ে রাখার অসম্ভব দক্ষতা ছিলো তার। সারাদিন সংবাদ সংগ্রহ শেষে সন্ধ্যার পূর্বে পত্রিকা অফিসে সংবাদ পাঠানোর অসম্ভব একটা প্রতিযোগিতা ছিলো তখন। সংবাদ লেখায় খেজুর ভাইয়ের মুন্সিয়ানার জুড়ি ছিলো না। ২০১৪ সালে নবীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের নির্বাচনে খেজুর ভাই সভাপতি নির্বাচিত হন। উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফোরামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে একজন দক্ষ ও সুযোগ্য সভাপতি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হন।

সাংবাদিক খেজুর ভাই আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু তার সাহসদীপ্ত পথ ধরে চলা নবীগঞ্জের সাংবাদিকতা থেমে নেই। আমরা যারা বেঁচে আছি তারা এ পথ ধরেই চলতে চাই। সে পথ যতই কণ্টকাকীর্ণ আর বন্ধুর হোক না কেন আমরা আমাদের সাংবাদিকতার নীতি থেকে বিচ্যুত হবো না। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা তিনি যেনো সাংবাদিক এটিএম নূরুল ইসলাম খেজুর ভাইকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করেন। আমিন। 

লেখক: বিশিষ্ট সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ

অধ্যক্ষ- রাণীগঞ্জ কলেজ, জগন্নাথপুর।

শেয়ার করুন