৫ জুন ২০২৩
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি : স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে হবিগঞ্জে অর্ধেকের বেশি নদী হারিয়ে গেছে। অনেক নদী পলি জমে পরিণত হয়েছে জমিতে। তবে বেশিরভাগ নদীই হয়েছে বেদখল। নদী তীরবর্তী জমির মালিকরা নিজেদের নামে কাগজ করে দখল করেছেন নদী। ফলে দিন দিন সংকুচিত হতে হতে এসব নদী একসময় হারিয়ে গেছে। এখনো যেগুলো টিকে আছে সেগুলোর অবস্থাও নাজেহাল। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এসব নদীও বিলুপ্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের দাবি, অবিলম্বে নদীগুলো খনন করে রক্ষণাবেক্ষণ করা দরকার। পাশাপাশি দখল হওয়া নদীর প্রবাহ ফেরাতে দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান আরও জোরদার করা প্রয়োজন।
সব নদীই উৎপত্তিস্থল থেকে পলি নিয়ে আসে। মাঝেমধ্যে ড্রেজিং না করলে একসময় পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যায়। এমনকি জমির সমান হয়ে যায়। তখন নদী তীরবর্তী জমির মালিকরা নদী দখল করেন। কোথাও কোথাও আবার এসব নদীর জমি স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের নামে কাগজপত্র পর্যন্ত করে নেন।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, মূলত দুই কারণে নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এর একটি কারণ প্রাকৃতিক, অন্যটি মানবসৃষ্ট। সব নদীই উৎপত্তিস্থল থেকে পলি নিয়ে আসে। মাঝেমধ্যে ড্রেজিং না করলে একসময় পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যায়। এমনকি জমির সমান হয়ে যায়। তখন নদী তীরবর্তী জমির মালিকরা নদী দখল করেন। কোথাও কোথাও আবার এসব নদীর জমি স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের নামে কাগজপত্র পর্যন্ত করে নেন।
তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে প্রশাসন এবং আমাদের (পানি উন্নয়ন বোর্ড) দায়িত্ব রয়েছে। প্রশাসন ছাড়া আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালাতে পারি না। প্রায়ই নদীর জমি দখলমুক্ত করার জন্য অভিযান চালাই, উচ্ছেদ করি। কিন্তু কিছুদিন পর আবার দখল হয়ে যায়। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। তারা যদি রক্ষণাবেক্ষণ না করেন তবে সে পরিকল্পনা পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
নদী রক্ষণাবেক্ষণ করতে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন জানিয়ে শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, নদী পুনর্খনন এবং নিয়মিত ড্রেজিং করা দরকার। অন্যথায় একসময় দেখা যাবে আরও কোনো কোনো নদী বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, সত্তর দশকে এ অঞ্চলে নদীর সংখ্যা ছিল অন্তত ৭০টি। এরপর পাঁচ দশকে অর্ধেকেরও বেশি নদী হারিয়ে গেছে। বর্তমানে মাত্র ২৬টি নদী সচল, সেগুলোও কোনোরকম টিকে আছে। কিছু মানুষের অযাচিত অত্যাচারে দিন দিন দখল-দূষণে শেষ হচ্ছে নদীগুলো। দিন যত গড়াচ্ছে নদীগুলো ততই সংকটজনক অবস্থায় পড়ছে।
তিনি বলেন, খোয়াই, পুরাতন খোয়াই, সুতাং, সোনাই, কুশিয়ারাসহ জেলায় যে কয়টি নদ-নদী এখনো টিকে আছে সেগুলোও দখল-দূষণে পর্যুদস্ত। একদিকে নদী দখল, নদীর বুক থেকে অনিয়ন্ত্রিত বালু-মাটি উত্তোলন, অন্যদিকে কলকারখানার বর্জ্য নিক্ষেপের মাধ্যমে দূষিত করা হচ্ছে নদী।
তোফাজ্জল সোহেল আরও বলেন, এক সময় হবিগঞ্জের বৃহৎ অংশ নদীবেষ্টিত ছিল। এসব নদী দিয়েই চলতো কৃষি, যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন। কিন্তু এখন অধিকাংশ নদী হারিয়ে যাওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। চাষাবাদের জন্য পানি পাওয়া যায় না। শুষ্ক মৌসুমে এখন টিউবওয়েলগুলোতে পানি ওঠে না। এ অবস্থায় পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষা করতে হলে নদীগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
বানিয়াচং উপজেলার কুতুবখানী গ্রামের সাবু মিয়া বলেন, ঝিংড়ি নদী বানিয়াচং উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এক সময় এ নদী দিয়ে বড় বড় নৌকা চলাচল করতো। আমরা বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতাম। নৌকা দিয়ে হাওর থেকে ধান আনা-নেওয়া করতাম। এ নদীর পানি দিয়েই আমরা হাওরের জমিতে সেচ দিয়েছি। পানির কোনো অভাব হয়নি। এখন নদী ভরাট হয়েছে, চর জেগেছে, পানি নেই। নদীতে পানি না থাকার কারণে আমাদের কয়েকটি হাওরের জমি ঠিকমতো আবাদ করতে পারি না।
গরিব হোসেন মহল্লার মো. সাইদুজ্জামান বলেন, আমাদের হাওরের নদী দিয়ে আগে বড় বড় নৌকা চলাচল করতো। সারা বছরই এখানে পানি থাকতো। এই নদী যদি পুনর্খনন করা হয় তবে হয়তো আমরা আবারও পানি পাবো। কৃষিজমির সেচের পানিরও অভাব হবে না।
নবীগঞ্জ উপজেলার কালিয়ারভাঙা গ্রামের ইব্রাহিম খলিল বলেন, এক সময় শাখাবরাখ ছিল খরস্রোতা নদী। এ নদী দিয়ে সারা বছরই চলাচল করতো বড় বড় নৌকা। ছোট লঞ্চও চলাচল করতো। কিন্তু এখন শাখাবরাখকে আর নদী বলার উপায় নেই। এটি এখন খালও না, রীতিমতো নালায় পরিণত হয়েছে। পানিও থাকে না, অনেক জায়গা ভরাট হয়ে দখল হয়ে গেছে। প্রবাহমান একটি বড় নদী চোখের সামনেই হারিয়ে গেলো!
সত্তর দশকে এ অঞ্চলে নদীর সংখ্যা ছিল অন্তত ৭০টি। এরপর পাঁচ দশকে অর্ধেকেরও বেশি নদী হারিয়ে গেছে। বর্তমানে মাত্র ২৬টি নদী সচল, সেগুলোও কোনোরকম টিকে আছে।
জানা গেছে, এক সময় হবিগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৭০টি নদী ছিল। এর মধ্যে খোয়াই, কুশিয়ারা, কালনী, করাঙ্গি, ঝিংড়ি, ভেড়ামোহনা, শাখাবরাখ, বিবিয়ানা, বলভদ্র, শুঁটকি, মেঘনা, ধলেশ্বরী, সোনাই, সুতাং ছিল অন্যতম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ও এসব নদী প্রবাহমান ছিল। তবে বিগত ৫২ বছরে ৪৪টি নদী বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে অস্তিত্ব আছে মাত্র ২৬টির। এসব নদীতেও ঠিকমতো পানি থাকে না। কোনো কোনোটা আবার দখল-দূষণের কবলে পড়ে হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।