৭ নভেম্বর ২০২৩
খলিলুর রহমান : সিলেটে সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) টানা ২ বারের কিবএনপি দলীয় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) দায়িত্ব ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন নবনির্বাচিত আওয়ামী মেয়র আনোয়ারুজ্জামানি চৌধুরীর কাছে। বিকেল ৩ টায় নগর ভবন মিলনায়তনে ঝমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তাই এখন থেকে আরিফুল হক চৌধুরী সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এবং আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী হয়েছেন বর্তমান মেয়র।
সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী টানা ১০ বছর শাসন করেছেন সিলেট নগর। নগর ভবনের মসনদে বসে আরিফুল হক চৌধুরী অনেকের কাছে যেমন হয়েছিলেন উন্নয়নের আইকন জননন্দিত মেয়র, তেমনি অনেকের কাছে হয়েছিলেন গননিন্দিত ও সমালোচিত সিসিক মেয়র।
আরিফুল হক চৌধুরী তার দীর্ঘ ১০ বছরের মেয়াদের প্রথমে একাধিক জঙ্গী মামলায় দু ‘বছর জেলও খেটেছেন। আগে ও পরে নগর উন্নয়নে অনেক কাজ করেছেন, সিলেটকে ঝলমলে পর্যটন নগরী গড়ে তুলতে নিরলস প্রচেষ্ঠা চালিয়েছেন তিনি। করেছেন দৃশ্যমান ও নজরকাড়া বহু উন্নয়ন। নগরে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন , নগরের সবকটি রাস্তা প্রশস্থ করন, খাল খনন, খালগুলোর দুপাশে পশে গার্ডওয়াল,অবর সময়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য দুপাশে ওয়াকওয়ে নির্মান, সবকটি জলাশয় ও দিঘীর উন্নয়ন, সবকটি দিঘীর পারে ওয়াকওয়ে, সুরমার দুইপারে ওয়াকওয়ে, বিভিন্ন পয়েন্টে জিজিটাল ডিসপ্লে স্থাপন, কয়েকটি গণসৌচাগার নির্মান, নগরের জিন্দবাজার ও বন্দরবাজারে বিদেশী স্টাইলে ডিভাইডার, নিশিকালীন ঝলমলে লাইট, বিভিন্ন স্থানে পয়ঃনিষ্কাশন বক্স কালভার্ট, রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে সুরম্য ট্রাফিক পয়েন্ট, পয়েঢন্টগুলোর নামকরণ, পাতাল বিদুৎ ( আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল) এর সূচনা,মসজিদ মাদ্রাসা, এতিমখানা, প্রভৃতির উন্নয়ন, সিকির্পোরেশনের অপদখলীয় ভূমি উদ্ধার এব্ং সর্বশেষ এশিয়া মহাদেশ বিখ্যাত দৃষ্টিনন্দন কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নির্মান করে নগরবাসীর অগাধ প্রশংসা কুড়িয়ে জননন্দিত মেয়র খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন আরিফ । তেমনি অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও নগরজীবনে স্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি এবং বিরাজমান দুর্ভোগ দুরীকরণে ব্যর্থতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে নিন্দা ও সমালোচনাও কুড়িয়েছেন তিনি।
অভিযোগ ছিল,,নগরীর উন্নয়নে তৎকালীন সিটি মেয়র আরিফুল হক অনেক প্রশংসা কুড়ালেও তার অপরিকল্পিত উন্নয়নে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে নগরবাসীকে। নগরীর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক কোনো পরিকল্পনা ছিলনা বলেই বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগও উঠেছিল। যখন যা মনে করছেন উন্নয়নের নামে সিটির ও সরকারী অর্থের অপচয় করছেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
উন্নয়নে সরকারী অর্থ বরাদ্দ পেয়ে নগরজুড়ে একসঙ্গে বছরব্যাপী চালিয়েছেন ইচ্ছেমত উন্নয়ন কাজ। নগরীর গ্যাস, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ বিভাগের যখন তখন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করেছেন। দিনের পর দিন কাজ না করে ফেলে রাখা বা কাজ শেষে রাস্তায় কার্পেটিং না করায়ও জনগণ ছিলেন অতিষ্ঠ।
অনেকে বলছেন, মেয়র উন্নয়ন বলতে রাস্তা সম্প্রসারণ, ওয়াকওয়ে ও ড্রেন নির্মাণকেই বোঝাতে চেয়েছিলেন। এ জন্য নগরের ফুটপাতকে শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের চলাচলে দীর্ঘমেয়াদে অনুপযোগী করে তুলেছিলেন। উন্নয়নের নামে তার পরিবেশবিরোধী বক্স-কালভার্ট নির্মাণকে অনেকে সমালোচনা চোখে দেখেছেন।
নগর জীবনকে নিরাপদ ও বনর্বিঘ্ন করে তুলতে তার কোনো কর্মকাণ্ডই পরিলক্ষিত হয়নি। নগরীকে যানজটমুক্ত করতে রাস্তা প্রশস্ত করণের নামে অনেক ঘরবাড়ি স্কুল কলেজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা ধ্বংস করেছেন। অনেকের মূল্যবান জায়গা ও ভূমি কেড়ে নিয়েছেন, উচ্ছদ করেছেন বাড়ি র্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট, ক্ষতি করেছেন অনেক বাণিজ্যিক ভবন ও বিনীবিতানের । কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কার্যত নগরকে যানজটমুক্ত নিরাপদ নগরী গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। মূলত নগরজীবনের উন্নয়ন না করেই অসাধু স্ট্যান্ড ব্যবসায়ী ও অবৈধ পরিবহন ব্যবসায়ীদের জীবনমান উন্নয়নেই ছিল তার সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।
অনেকের মতে নগরের যানজট নিরসনে মূলকাজ যাবাহনের প্রবৃদ্ধি বন্ধ করতে ও যানচলাচল নিয়ন্ত্রনে না এনে শুধু রাস্তা প্রশস্থ করেছেন তিনি। কেড়ে নিয়েছেন অনেকের দোকানপাট ও ভূমি। ফলে চাঁদবাজ ও স্ট্যন্ডবাজদের হয়েছে পোয়াবারো। মূলত তাদের অবৈধ কামাইয়ের পথ প্রশস্থ করে দিয়েছিলেন তিনি। ফলে প্রশস্থ রাস্তাগুলোতে গড়ে উঠে নতুন নতুন অবৈধ স্ট্যান্ড। তার আমলে জনচলাচলের ফুটপাতগুলো আকারে আয়তনে ছোট করে তুলেছিলেন তিনি। রাস্তাঘাট প্রশস্থ করে মূলত হকার ব্যবসায়ীদের ভাগ্যই প্রশস্থ করে দিয়েছিলেন তিনি।
হকারমুক্ত নগর গড়ার নামে আরিফ কোটি কোটি টাকায় নির্মিত লালদিঘী হকার মার্কেট ধ্বংস করেছেন, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে মাটিভরাট করেছেন, কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে হকারমুক্ত নগর গড়তে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। ফলে তার আমলে হাকার ব্যবসায়ী চাঁদাবাজরা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হতে পেরেছিলেন।
উন্নয়নের নামে সাবেক মেয়র আরিফ নগরীর সবুজ প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনষ্ট করেছেন। সুয়্যারেজ লাইনের পানি সরাসরি সুরমা নদীতে পড়ে দূষিত হয়েছে পানি। তার সময়ে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বল্প মূল্যে আবাসন ব্যবস্থা তৈরির কোনো উদ্যোগ ছিল না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নাম করে অনেক অর্থ অপচয় করলেও সফলতা দেখাতে পারেননি।
হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছেন পরিকল্পনা ছাড়াই। তার সময়ে সিটি করপোরেশনে ছিলেন না নগর পরিকল্পনাবিদ। ফলে সরকার এ বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে অতিদ্রুত নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিবার নির্বাচনের আগে মাস্টার প্ল্যানের কথা বলা হলেও এ বিষয়ে মেয়রের ভূমিকােই ছিল না। নগর পরিকল্পনাবিদদের পাশ কাটিয়ে বিশিষ্ট সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের পরামর্শ নিয়েই পরিকল্পনাহীন ভঙ্গুর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন।
তার সময়ে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল সেকশনেও ছিলনা দক্ষ জনবল। অদক্ষতা, নানাবিধ দুর্নীতির কারণে এবং নজরদারির অভাবে পাস করা নকশা পরিবর্তন করে নগরীতে ইচ্ছেমতো গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। রাস্তা সম্প্রসারণের কাজেও ছিল অনিয়ম-দুর্নীতির জুলুম ও স্বেচ্ছাচারিতার নানা অভিযোগ।
গণমাধ্যমের কাছে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী দেওয়া তথ্যমতে সিলেট সিটিতে ৯৭০ কিলোমিটার ছড়া এবং ড্রেন । ৩৫০ কিলোমিটার ফুটপাত, ৬৬৮ কিলোমিটার রাস্তা। তার সময়ে নগরীর ছড়াগুলোতে ১০০ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাস্তবে রাস্তা প্রশস্থ করণ ও ড্রেন নির্মানে নগরের বসতবাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অফিস আদালতসহ শত শত কোটি টাকায় নির্মিত সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন স্থাপনার স্থল লেভেলের কোনো তোয়াক্কাই করেনি।আর এ কারণে উন্নয়ন কাজ করায় অনেক বাসা বাড়ি ও স্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এমনো দেখা গেছে, সামান্য বৃষ্টিতে হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হাটুজল হলেও রাস্তা ও ডেন ছিল শুকনো। অপরিকল্পিত রাস্তা ও ড্রেন নির্মান করে সিলেট নগরকে বসবাসের অনুপযোগিী করে তুলেন বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন।
সিটির নগারিকদের অধিকাংশই উন্নয়ন কাজের প্রশংসা করলেও অনেকে সমালোচনা করছেন পরিকল্পনা বিহীন উন্নয়নের কারণেই।
একই রাস্তায় একটা প্রকল্প শেষ হতে না হতে শুরু হচ্ছে আরেকটি। এতে নাগরিক জীবন প্রায় স্থবির হওয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল। যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন নগরের সর্বস্তরের মানুষ। অপরিকলিপত উন্নয়নের ছোবলে পড়ে শিক্ষকবি আব্দুল বাছিত মোহাম্মদসহ অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। তার আমলে নগরের ব্যবসা ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
অনেকে অভিযোগ করেছেন, মেয়র আরিয়ের সময়ে নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় নাগরিক সেবার বিষয়টির প্রাধান্য দেয়া হয়নি । সিটি মেয়র নতুন ফুটপাত তৈরি করেছেন। এটা প্রশংসনীয়। তবে দেখতে হবে নিয়ম মেনে ফুটপাত তৈরি করা হয়েছে কিনা। একজন অন্ধলোকও এই ফুটপাত ধরে হেঁটে যেতে পারে কিনা- সেটা ভাবতে হয়। ফুটপাতকে দখলমুক্ত রাখতে হবে।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে এজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেছিলেন, সিলেটের জনপ্রতিনিধিরা আধুনিক নগরায়নের চিন্তা-চেতনার মূল ধারার কাছে নেই। তাদের মধ্যে সুদূরপ্রসারী কোনো ভিশনও নেই। তারা মনে করেন, বিল্ডিং আর রাস্তা সম্প্রসারণই হলো নগরজীবনের উন্নয়ন।
কেউ কেউ বলেন, প্রকৃতি বাঁচিয়ে গাছ বাঁচিয়ে নগর উন্নয়নের চিন্তাই করা হয়নি।এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মেয়র আরিফের সময়ে সিলেট নগরে ৫০% সবুজের আচ্ছাদন কমেছে। পয়েন্টগুলোতে বিশ্রি মনুমেন্ট নির্মাণ হয়েছে।
অনেকের মতে আরিফ আমলে দৃশ্যত সিলেট নগর বেশ সুন্দর হয়েছে, তবে যানচলাচল নিয়ন্ত্রনে আনতে না পারায় এবং নগর পরিবেহনের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারায় যাতায়াত ও জচলাচলের মূল সমস্যা বিন্দুমাত্র দুরীভুত হয়নি।