হোসেইন ফাহমি : হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন আবু আহমেদ, নিজের অজান্তে দুচোখে টলমল করছে অশ্রু সেদিকে মোটেও খেয়াল নেই। ব্যস্ত এই শহরের খেটে খাওয়া আবু আহমেদ প্রতিদিন সকালে বের হন জীবিকার তাগিদে আর প্রয়োজনীয় সদাইপাথি নিয়ে রাতে ঘরে ফেরেন। আজ রুটিনে কিছুটা পরিবর্তন, কাজ শেষে বাসায় না ফিরে একটি নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালে এসেছেন ছাত্রজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশের নামকরা ব্যাংকার এইচ. কবির সাহেবের অসুস্থ পিতাকে দেখতে। ফেইসবুকের স্ট্যাটাস থেকে জানতে পেরেছেন কবির সাহেবের পিতার পড়ে গিয়ে পায়ের হাড্ডি ভেঙে গেছে। একি শহরে বসবাস হলেও অনেকদিন হল বন্ধুর সাথে দেখা সাক্ষাত বা কথা কোনটাই হয়না আবু আহমদের। অসুস্থতার খবর পেয়ে মনটা চটফট করছিল তাই দেখতে হাসপাতালে আসা। অনেক খুজাখুজি করেও রুগী পেলেননা, এত বড় হাসপাতাল পাবেন কোথায়। নাম্বার মুখস্থ থাকলেও তিন বছর হলো বন্ধুর মোবাইলে কল দেওয়া হয়নি তাই কি করবেন ভাবছিলেন। মনের বাধা উপেক্ষা করে শেষতক কল দিলেন কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। হয়তো ব্যস্ততা অথবা মোবাইলের পাশে কেউ নেই দেখলে অবশ্যই কল ব্যাক করবেন কবির সাহেব। এই আশায় আনমনে দাড়িয়ে অনেক কিছুই ভাবছেন আবু আহমেদ।
বন্ধুত্ব এমন ছিল যে, এক বিছানায় রাত্রি যাপন এক প্লেইটে খাওয়া, সময় পেলেই একত্রে বসে জিবনের গল্প বলে যাওয়া।
দুই বন্ধুর একজন ছিলেন মধ্যবিত্ত পড়তেন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে অন্যজন নিম্নমধ্যবিত্ত তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া উপায় ছিলনা। কেননা পার্টটাইম চাকুরী ছাড়া লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল।
একদিন দুই বন্ধু বসে গল্প করছেন হঠাৎ-
আবু আহমেদঃ কবির তুইতো অনেক মেধাবী আর অনেক ভাল ভাল লিংক আছে। আজকের এই অবস্থা বদলে অনেক বড় কিছু হয়ে যাস তাহলে কি আমাকে চিনবে?
এইচ. কবিরঃ (মুচকি হেসে) বন্ধু চিনতেই যদি পারলাম তাহলে আর বদলালাম কি?
উত্তর শুনে দুজনেই একসাথে কি হাসাহাসি(ভাবটা এমন যেন জীবনে এমন না চিনবার দিন আসতেই পারেনা)
লেখাপড়া শেষ করে এক বন্ধুর আত্বীয়ের কল্যানে কবির সাহেব চাকুরী নিলেন ভাল ব্যাংকে আর আবু আহমেদ সাহেবের ভাগ্যে পূর্বের ছোট মাইনের চাকুরীটা ফুলটাইম হিসেবে গলার মালা হয়ে ঝুললো। সেই থেকেই আস্তে আস্তে সামাজিক স্ট্যাটাস আর এড়িয়ে চলা শুরু। মাঝে মধ্যে যোগাযোগ ও ফোনালাপ ছিল দুজনের মধ্যে। কিন্তু তিনবছর পূর্বে কোন এক বিকেলে ফোনে কি জানি ছোট একটি বিষয়ে দুজনের কথা কাটাকাটি সেই থেকে আজ অবধি কোন যোগাযোগ নেই। তবে যদিও রিপ্লাই পাননা তবুও এইচ. কবির সাহেবের জন্মদিনে উইশ করেন আবু আহমেদ। এ যেন হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা।সেই ভালবাসার টানেই বন্ধুর পিতাকে দেখতে এসেছেন আবু আহমেদ।
কিন্তু একি হলো ঘন্টার উপরে যে সময় অতিবাহিত হলো কল ব্যাক করছেননা কবির সাহেব। দেখেও কল রিসিভ করছেননা নাকি দেখেননি, নাকি অসুস্থতারও সামাজিক স্ট্যাটাস আছে যে, অসুস্থ হলেও যে কেউ বড়লোকদের দেখতে পারবে না। এরকম অনেক প্রশ্ন মনে নিয়ে ব্যর্থ মনোরথে হাসপাতাল থেকে ফিরে আসছিলেন আবু আহমেদ। আর বারবার চোখের সম্মুখে ভাসছিল ১৪ বছর আগে বলা বন্ধু কবির সাহেবের কথাটি “চিনতেই যদি পারলাম তাহলে আর বদলালাম কি?”
নশ্বর এই পৃথিবীতে হাইপ্রোফাইলের একটি চাকুরী আর কিছু টাকা হাতে পেয়ে বদলে যায় কবীর সাহেবরা। মৃত্যু ঘটে বন্ধুত্ব আর ভালাবাসার। তবুও মানবতা নিয়ে বেচে থাকেন আবু আহমেদরা।