২৫ অক্টোবর ২০২০
ডেস্ক রিপোর্ট : বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে যুবক রায়হান নিহতের ঘটনায় এবার গ্রেফতার দেখানো হয়েছে কনস্টেবল হারুনুর রশিদকে। আদালত তার ৫ দিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেছেন। ওই মামলায় প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে যুক্ত করা রায়হানকে গ্রেফতারকারী এএসআই আশেকে এলাহীকে যে কোন সময় গ্রেফতার দেখানো হতে পারে। একই সাথে পুলিশ বাহিনীর বাইরে ঘটনার দিন ছিনতাইর তথ্যদানকারী ব্যক্তিকেও আদালতে তুলতে পারে পিবিআই। পুলিশের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী তিন পুলিশ সদস্যের আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে উঠে এসেছে রায়হানের প্রতি নির্মমতার চিত্র। ফলে যত সময় যাচ্ছে; ক্ষোভ বাড়ছে জনমনে। অন্যদিকে রায়হান হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। শনিবার বিকেলে নগরীর মদীনা মার্কেটে আখালিয়া বারো হামছা সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন।
আদালতে তিন প্রত্যক্ষদর্শী যা বলেছিলেন
রায়হানকে তুলে আনা হয়েছিলো নগরীর কাস্টঘর এলাকা থেকে। সেই রাতে রায়হানের উপর চালানো নির্যাতনের ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে প্রত্যক্ষদর্শী তিন পুলিশ সদস্যের মুখে। আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে কর্মরত পুলিশ কনস্টেবল সাইদুর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন ও শামীম মিয়া তুলে ধরেছেন সেদিনকার নির্মমতার কথা।
কনস্টেবল শামীম মিয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, ১০ অক্টোবর রাত ২টার দিকে বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক পড়াশোনা শেষ করে ফাঁড়ির মুন্সির কক্ষে তিনি ঘুমিয়ে যান। রাত ৩টার পর কক্ষের ভেতরেই কান্নার আওয়াজ শুনে তার ঘুম ভেঙে যায়। দেখতে পান রায়হানের দুই হাত পেছনের দিকে হাতকড়া লাগানো। মেঝেতে বসে চিৎকার করছেন তিনি।
কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস মোটা লাঠি দিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করছেন। এক পর্যায়ে তিনি ডান দিকে কাত হয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লে কনস্টেবল টিটু তার পায়ের তলায় আঘাত করে। তখন কনস্টেবল হারুনুর রশিদ রুমে প্রবেশ করেন। তিনিও রায়হানকে মারধর শুরু করেন। এ সময় এএসআই আশেক এলাহী ও কুতুব উদ্দিন রুমে উপস্থিত ছিলেন। আর রুমের দরজায় দাঁড়ানো ছিলেন কনস্টেবল তৌহিদ ও সজিব।
এর কিছুক্ষণ পর রুমে প্রবেশ করেন ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন। তিনি টিটুর হাতের লাঠি নিয়ে রায়হানকে তার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞাসা করেই বেধড়ক পেটাতে শুরু করেন। তার মারমুখী আচরণ দেখে এএসআই কুতুব আকবরকে বলেন, ‘স্যার আর মাইরেন না। তখন আকবর রুমের একটি বিছানায় লাঠি হাতে নিয়ে বসে যান।’ সকাল সাড়ে ৭টায় সিয়েরা-৪ ডিউটিতে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠে দেখি রায়হানকে যেখানে মারধর করা হয়েছে সেই স্থানটি ভেজা। সকাল ৯টায় আমরা ওসমানী মেডিকেলের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের স্টোরে গিয়ে দেখি একটি লাশ রাখা আছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে কনস্টেবল তৌহিদ। তখন লাশটি দেখে আমি চিনতে পারি।
প্রত্যক্ষদর্শী কনস্টেবল সাইদুর আদালতকে জানান, বন্দরবাজার ফাঁড়ির মুন্সি কনস্টেবল আমিনুলের রুমে কনস্টেবল হারুন রায়হানের পা উঁচু করে ধরে রাখেন আর এসআই আকবর ও কনস্টেবল টিটু তার পায়ের পাতা এবং পায়ে আঘাত করেন। এ সময় এএসআই আশেক এলাহী আকবরকে বলেন, রায়হান পুলিশের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে তার পায়ে মারেন। পায়ে মারলে সমস্যা নেই। তখন আকবর আমাকে ধমক দিয়ে সেন্ট্রি পোস্টে পাঠিয়ে দেন। এরপর বেশ কয়েকবার রায়হানের চিৎকার শুনতে পাই। ভোর ৪টায় কনস্টেবল দেলোয়ারকে আমি ডিউটি বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাই।
সাইদুর আদালতকে বলেন, পরদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় বন্দরবাজার ফাঁড়ির মুন্সি কনস্টেবল আমিনুল ডিসি স্যারের (এসএমপির উপকমিশনার উত্তর আজবাহার আলী শেখ) কথা বলে ফাঁড়িতে ডাকেন।
আসার পর আকবর স্যার বলেন, ‘সিনিয়র স্যাররা এলে বলবি, ফাঁড়িতে কোনো লোক এনে নির্যাতন করা হয় নাই। সে (রায়হান) কাস্টঘর থেকে গণপিটুনি খেয়ে ধরা পড়েছে। তাকে সরাসরি ওসমানী হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।’ আমি যা বলছি তাই বলবি। আমার বুকে হাত দিয়ে আকবর স্যার হুমকি দিয়ে আরও বলেন, ‘সত্য কথা বললে বুকে গুলি করব, পিঠ দিয়ে বের হবে।’
কনস্টেবল দেলোয়ার তার বক্তব্যে সাইদুরের মতো একইভাবে এসআই আকবর কনস্টেবল দেলোয়ার হোসেনকেও হুমকি দিয়েছেন বলে তিনি আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছেন।
দেলোয়ার আদালতে বলেন, কনস্টেবল তৌহিদ ফাঁড়ির সেন্ট্রি পোস্টে তার সঙ্গে গল্প করছিল। এ সময় আকবর স্যার তৌহিদকে ডেকে নেন। এরপর তৌহিদ এসে জানায়, আকবর স্যার তার মোবাইল নিয়ে রায়হানকে দিয়ে তার বাসায় কল দিয়ে ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসতে বলেছেন। এরপর আকবর স্যার এএসআই আশেক এলাহীকে বলেন, আমি ঘুমিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর রায়হানকে হাসপাতালে নিয়ে যেও। ফজরের আজানের পরপর রায়হানের চাচা এলে তাকে নিয়ে নামাজে যান এএসআই আশেক এলাহী।
নামাজ থেকে এসে আশেক এলাহী রায়হানের চাচাকে বলেন, স্যার ঘুমিয়ে গেছেন আপনি সকাল ৯টার পর আসেন। সকাল ৬টা ২০ মিনিটের দিকে এএসআই আশেক এলাহী ও কনস্টেবল হারুন রায়হানকে ধরে বের করে নিয়ে আসেন এবং সিএনজি আটোরিকশায় তুলেন। তারা আমাকে জানান, তাকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আধাঘণ্টা পর আকবর স্যার ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়া করে ফাঁড়ি থেকে বেরিয়ে যান। সকাল ৮টায় আমি কনস্টেবল ইলিয়াসকে ডিউটি বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাই।
অন্য জড়িতদের গ্রেফতার যে কোন সময়
রায়হান হত্যা মামলায় একে একে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ ঘটনার বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে যুক্ত করা রায়হানকে গ্রেফতারকারী এএসআই আশেকে এলাহীকে যে কোন সময়ে গ্রেফতার দেখানো হতে পারে। একই সাথে পুলিশ বাহিনীর বাইরে ঘটনার দিন ছিনতাইর তথ্যদানকারী ব্যক্তিকেও আদালতে তুলতে পারে পিবিআই। পুলিশের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, ঘটনার রাতে মহাজনপট্টি এলাকার হোটেল মশরাফিয়ায় অবস্থানকারী পুলিশ সদস্যদের কাছে ছিনতাইয়ের তথ্য যে ব্যক্তি দিয়েছিলো, তাকে সনাক্ত করেছে পিবিআই। সেই ব্যক্তি এখন পিবিআইয়ের নজরদারিতে। তাকে নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িসহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় সরেজমিনে গিয়েছে পিবিআইয়ের তদন্ত দল। এছাড়া,অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরাও তাকে সনাক্ত করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, পুলিশ সদস্যদের বাইরে ঐ ব্যক্তিকেও আদালতে তুলা হতে পারে যে কোন সময়। এছাড়া এ এস আই আশেকে এলাহী পুলিশ লাইন্সে নজরদারিতে রয়েছেন। তাকেও যে কোন মুহূর্তে আইনি ব্যবস্থাপূর্বক গ্রেফতার দেখানো হতে পারে। সর্বশেষ এই মামলায় রায়হানকে নির্যাতনে সরাসরি জড়িত এমন দুই কনস্টেবল আটক রয়েছেন। বাকীদের পর্যায়ক্রমে আইনের আওতায় নিয়ে আসছে পিবিআই।