২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১
বিশেষ প্রতিবেদক : স্বাধিকার আন্দোলনের সূঁতিকাগার ভাষা আন্দোলন। ভাষা শহীদদের স্মরণের স্মৃতিচিহ্ন শহীদ মিনার। অথচ শহীদ স্মৃুতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া থেকে বঞ্চিত সিলেটের বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা। জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারেই হোক সিলেটের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে ওঠেনি শহীদদের স্মৃতিচিহ্নটি। ফলে চেতনার উৎস ভাষার স্মৃতির পরিচয় থেকে পিছিয়ে সিলেটের শিশুরা।
সিলেটের অসংখ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শহীদ মিনার নেই বললেই চলে। সিটি কর্পোরেশন ও জেলায় প্রায় ১৫শ’ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও শহীদ মিনার আছে মাত্র ১৯৩টিতে। এর সিংহভাগই পশ্চাদপদ উপজেলা হিসেবে পরিচিত সিলেটের কানাইঘাটে। অন্যসব উপজেলার তুলনায় কানাইঘাটবাসী শধু এগিয়েই নয়, কয়েকগুণ এগিয়ে।
এরমধ্যে আবার জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাটের কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদমিনার নেই। সংশ্লিষ্টরা এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোর প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে অনীহা বা অনাগ্রহের কারণে ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে সিলেটের শিশুরা। আর শহীদমিনার না থাকা বা পিছিয়ে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যেসব যুক্তি দিচ্ছেন, তা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা মাত্র।
বাংলা ও বাঙালির আবেগ অনুভূতির কেন্দ্র শহীদ মিনার। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি পাক শাসকরা ভাষা শহীদদের লাশ ফেরত দেয়নি। নিজেরাই মাটিচাপা দিয়েছিল আজিমপুর গোরস্তানে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনার নির্মাণের পর সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন- এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে এক রাতের মধ্যেই প্রথম শহীদ মিনারটি বানিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে।
পরে অবশ্য পাক বুলডোজার সেটিও গুড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে কি! এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের প্রায় সব জেলায়, এমনকি তৎকালীন অনেক থানা সদরেও নির্মাণ শুরু হয়েছিল ভাষা শহীদদের স্মৃতির মিনার।
আমাদের চেতনার উৎস ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রাখা ও সালাম বরকত রফিক জব্বার শফিউলদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাত বর্তমান সরকারন ক’বছর আগে দেশের প্রতিটি স্কুলে শহীদমিনার তৈরির আহবান জানিয়েছিলেন।
পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলেও সরকারের নির্দেশনায় ছিল, স্কুল মেরামতের কাজ করতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা থেকে বেঁচে যাওয়া টাকার সাথে স্থানীয় দাতাদের উদ্বুদ্ধ করে যেনো কাজটি করা হয়। এই আহবানে খুব একটা সাঁড়া মিলেনি সিলেট অঞ্চলে।
এজন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা স্থানীয় দাতাদের অনাগ্রহের অজুহাত দাঁড় করার অপচেষ্টা করেন। তাদের সেই অজুহাত যে কেবল নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার অপচেষ্টা, তারই প্রমাণ কানাইঘাট উপজেলা।
সিলেট বিভাগের পশ্চাদপদ উপজেলা হিসাবে পরিচিত এ উপজেলায় মোট ১৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯০টিতে শহীদমিনার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। এর বিপরীতে উন্নত বা আর্থিকভাব অনেকটা এগিয়ে থাকা সিলেট সদরের ১২৫টির মধ্যে ১৯ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে শহীদমিনার আছে। ‘এ’ শ্রেনীর উপজেলা খ্যাত গোলাপগঞ্জে ১৮০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে শহীদমিনার আছে ১৯টিতে, প্রবাসী অধ্যুষিত বিয়ানীবাজারের ১৫০টির বিদ্যালয়ের বিপরীতে ১০টিতে, বালাগঞ্জের ৭২টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫টিতে, ওসমানীনগরের ১১০টির মধ্যে ১১টিতে শহীদ মিনার স্থাপিত আছে।
সবচেয়ে হতাশার খবর হচ্ছে, পাথর কোয়ারি আর পর্যটনের জন্য বিখ্যাত গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরের কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই। শহরতলী দক্ষিণ সুরমায় ১১৬টি বিদ্যালয়ের বিপরীতে শহীদ মিনার আছে মাত্র ১টি তে।
আর গোয়াইনঘাটে ১৩৬ ও জৈন্তাপুরে ৭২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও গড়ে ওঠেনি শহীদ স্মৃতি। এছাড়া জকিগঞ্জে ২, কোম্পানীগঞ্জে ৯, ফেঞ্চুগঞ্জের ৫ ও বিশ্বনাথের ২০টি বিদ্যালয়ে আছে স্মৃতির মিনার। সংশ্লিষ্ট এসব উপজেলাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অনেকে মোবাইল ফোন রিসিভ না করায় মোট স্কুলের সংখ্যাটি জানা যায়নি।
প্রবাসী অধ্যুষিত উপজেলাগুলোকে পেছনে ফেলে শহীদমিনার নির্মাণের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন প্রসঙ্গে কানাইঘাট উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস বলেন, আমি তেমন কিছু করিনি। স্কুলগুলোর ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে স্থানীয় প্রবাসী ও দাতাদের উদ্বুদ্ধ করেছি। সরকারের আহবানের কথা জানিয়েছি। এতেই কাজ হয়েছে। তারা এগিয়ে এসেছেন। কৃতিত্বটা স্থানীয় ও প্রবাসী দাতাদের।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বালাগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, দক্ষিণ সুরমা, ওসমানীনগর ও জৈন্তাপুরের উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা যথাক্রমে যথাক্রমে জহিরুল ইসলাম, রুমান মিয়া, আবদুর রকিব ভুঁইয়া, মিষ্টার প্রতুল, আবদুর রাজ্জাক ও মো. আবদুল জলিল তালুকদার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো বক্তব্য দিয়েছেন। গ্রামেগঞ্জের মানুষ শহীদ মিনার নিয়ে অতোটা আগ্রহী নয় বলেও জানালেন তারা। আর এখাতে নাকি সরকারি বরাদ্দও নেই। তবে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কানাইঘাটের উদাহরণ টানতেই তাদের কেউ কেউ বললেন- জ্বি, আমাদের চেষ্টারও ত্রুটি নেই।
সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বায়েজিদ খান বলেন, ‘আমি বিভিন্ন জেলায় কাজ করেছি। কিন্তু সিলেটের মতো হতাশাজনক চিত্র কোথাও দেখিনি। সরকারের নির্দেশনা ছিল ব্যবস্থা কমিটির ও দাতাদের সহযোগীয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংস্কারের টাকা থেকে শহীদ মিনার করার। কিন্তু সিলেটের বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে তা অনুপস্থিত। অবশ্য প্রত্যেক বিদ্যালয়ে শহীদ করার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানা, জীবনের শুরুতেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জন্ম দেওয়া বা জাগিয়ে তুলে দেশে প্রমিক সচেতন নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতেই শহীদমিনার নির্মাণ জরুরী। সম্ভবতঃ এ কারণেই সরকারের আহবান বা নির্দেশনা ছিলো। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অবহেলা বা আন্তরিক প্রচেষ্টার অভাবে তা আলোর মুখ দেখছে না।