২৯ মার্চ ২০২১


প্রস্তুত রায়হান হত্যা মামলার চার্জসীট

শেয়ার করুন

কাউসার চৌধুরী : নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। আগামী সপ্তাহের যেকোনো দিন আদালতে অভিযোগপত্র দেবে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। হত্যাকান্ডের মূল হোতা বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক আকবর হোসেন ভূইয়াসহ ৬ পুলিশ সদস্যকে চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খালেদ-উজ জামান জানিয়েছেন, রায়হান হত্যা মামলার অভিযোগপত্র শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী সপ্তাহের যেকোনো সময় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হবে। অভিযোগপত্রে দারোগা আকবরসহ কয়জনকে আসামী করা হবে তা তিনি জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমানকে আসামী করা হবে কিনা তাও বলতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেছেন, অভিযোগপত্রে বিস্তারিত থাকবে। অভিযোগপত্র দেয়ার পরই সংবাদ সম্মেলন করে মিডিয়ায় পুরো বিষয়টি তুলে ধরা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রায়হান আহমদ হত্যা মামলার তদন্তের সময় বর্ধিত করার জন্যে গত ১০ ফেব্রুয়ারি সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আব্দুল মুমিনের আদালতে আবেদন করা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি শুনানীর পর আদালত ৩০ কার্যদিবস বৃদ্ধি করেন। এরপর থেকেই তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ পিবিআই কর্মকর্তারা রায়হান আহমদ হত্যা মামলার আদ্যোপ্রান্ত নিয়ে পর্যালোচনা করে অভিযোগপত্র তৈরির দিকে অগ্রসর হন।
পিবিআই প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি পাওয়ার পরই অভিযোগপত্র তৈরির কাজ শুরু করেন। টানা কয়েকদিনে অভিযোগপত্র তৈরি শেষ পর্যায়ে। চলতি সপ্তাহের যেকোন দিন অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বরখাস্ত হওয়া উপ-পরিদর্শক আকবর হোসেন ভূইয়া ও হাসান আলী, সহকারী উপ-পরিদর্শক আশেকে এলাহী, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, কনস্টেবল তৌহিদ মিয়া ও কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে অভিযোগপত্রে আসামী করা হচ্ছে। তবে কোম্পানীগঞ্জের সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমানের বিষয়ে সূত্রটি নিশ্চিত করতে পারেনি। সাংবাদিক নোমান ও পুলিশ কর্মকর্তা হাসানসহ আলামত নষ্ট করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র জানায়, গত ২৯ জানুয়ারি সর্বশেষ এসআই হাসান আলীকে গ্রেফতার করে পিবিআই। এরপর তাকে একদিনের রিমাণ্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি চাঞ্চল্যকর বেশকিছু তথ্য দেন। ঘটনার পর দ্রুত নগরীর জল্লারপারের গ্যালারিয়া শপিং সিটির একটি দোকান থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার ৫০০ গিগাবাইটের হার্ডডিস্ক কিনে এনে বন্দরবাজার ফাঁড়ির পুরনো হার্ডডিস্কটি বদলে দেন হাসান ও নোমান। ঘটনার পর সাময়িক বরখাস্ত আকবর তার অস্ত্র টুআইসি হিসেবে হাসানের নিকট জমা দেয়। এরপর আকবরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন হাসান। ঘটনার আগে ও পরে ২৪ ঘণ্টায় হাসান ও নোমানের মাঝে অন্ততঃ ৫৯ বার মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে। হাসান ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট আকবর পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও প্রথমে গোপন করেন। রিমান্ডে এ সকল তথ্য দেয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ আরো কিছু তথ্য দেন দারোগা হাসান।

জানা গেছে, রায়হান হত্যার পর ২১ অক্টোবর এসআই হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করে মহানগর পুলিশ। এরপর থেকে তাকে নগর পুলিশ লাইন্সে বিশেষ নজরদারীতে রাখা হয়েছিল। রায়হান হত্যার পর হাসান, আকবরসহ এ পর্যন্ত ৬ পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য চারজন হলেন, এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল হারুনুর রশীদ, কনস্টেবল তৌহিদ মিয়া ও কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস।

হত্যাকাণ্ডের দু’দিন পর ১৩ অক্টোবর মামলাটি কোতোয়ালী থানা থেকে পিবিআই’র কাছে স্থানান্তর করে পুলিশ সদর দপ্তর। এর আগের দিন নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-২০। ধারা ৩০২/৩৪ দণ্ডবিধি তৎসহ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ১৫(১)(২)(৩)২০১৩।
রায়হান হত্যার পর সাময়িক বরখাস্তের পরই কৌশলে সাংবাদিক নোমানের সহযোগিতায় নগর ছেড়ে কোম্পানীগঞ্জে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করে আকবর। এরপরই ভারতে পালিয়ে যায়। ৯ নভেম্বর সকালে কানাইঘাটের ডনা সীমান্ত থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। বিভিন্ন মাধ্যমে কৌশলে পুলিশ তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

প্রসঙ্গত, নগরীর আখালিয়ার নেহারীপাড়ার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে ১১ অক্টোবর দিবাগত রাতে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে আসে। রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে স্বাভাবিক অবস্থায় রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে আনে পুলিশ। সকাল ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে রায়হানকে ফাঁড়ি থেকে বের করা হয়। ৬টা ৪০ মিনিটে ওসমানী হাসপাতালে নেয়া হয় এবং ৭টা ৫০ মিনিটে মারা যায় রায়হান। ঐ দিনই ময়না তদন্ত শেষে তার লাশ দাফন করা হয়।

পরে ১৫ অক্টোবর কবর থেকে রায়হানের লাশ উত্তোলন করে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়। নির্যাতনে রায়হানের হাতের দু’টি আঙ্গুলের নখ তুলে ফেলে দারোগা আকবর। রাতভর নির্যাতনে রায়হানের শরীরে ময়নাতদন্তে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৪টি আঘাত ছিল গুরুতর। নির্যাতনের সময় রায়হানের আর্তচিৎকারে ফাঁড়ির পার্শ্ববর্তী কুদরত উল্লা রেস্ট হাউসের বর্ডারদের ঘুম ভেঙে যায়। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের পর ঘাতকদের গ্রেফতারের দাবিতে দলমত নির্বিশেষে সিলেটবাসী আন্দোলনে নামেন। সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, মিছিল-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। বৃহত্তর আখালিয়াবাসী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেন।

শেয়ার করুন