৭ জুন ২০২১
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার দোয়ারাবাজার ডিগ্রি কলেজ থেকে উপজেলা পরিষদ হয়ে পূর্ব মছিমপুর পর্যন্ত এবং লহ্মীবাউর ও বেতুরা এলাকার নদীভাঙন ঠেকানোর জন্য ১৯১ কোটি টাকার নদীশাসন কাজ চলছে। গেল নভেম্বর থেকে ওই এলাকায় ব্লক ফেলা এবং বিছানোর জন্য ব্লক তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু ভাঙনরোধে এখনো কোনো ব্লক ফেলা হয়নি। ব্লক তৈরিতেও অনিয়মের কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা বলেছেন, ব্লক তৈরিতে কাটা পাথরের বদলে সিঙ্গেল ব্যবহার হচ্ছে। মাটিযুক্ত বালুও দেয়া হচ্ছে শুরু থেকেই। শুধু তাই নয়, এরমধ্যেই প্রকল্প এলাকায় ভয়াবহ ভাঙনে এলাকা ছাড়ছেন মানুষ। নদীভাঙনের শিকার নিরূপায় পরিবারগুলো স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী কিংবা ঠিকাদার কেউই ভাঙন ঠেকাতে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি বলে অভিযোগ।
পাউবোর প্রকৌশলী সবিবুর রহমান অবশ্য বলেছেন, প্রজেক্টের ভেতরে কাজ চলমান অবস্থায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার দিয়ে ভাঙন নিয়ন্ত্রণের কাজ করা হবে।
ভাঙন-কবলিত এলাকার বাসিন্দারা জানান, নদীভাঙন থেকে দোয়ারাবাজারকে রক্ষার জন্য ১৯১ কোটি টাকার নদীশাসনের কাজ হচ্ছে। গেল জুন মাসে এই প্রকল্প অনুমোদিত হয়ে ঠিকাদার নিয়োগ শেষে নভেম্বর থেকে ব্লক বিছানোর কাজ হচ্ছে। এরমধ্যেই গেল মার্চ মাস থেকে উপজেলা সদরের মাজেরগাঁও, মংলারগাঁও, পুর্ব মাছিমপুর, পশ্চিম মাছিমপুর ও মুরাদপুর গ্রামে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে।
পূর্ব মাছিমপুরের ১৮টি পরিবার ইতোমধ্যে ভিটে-মাটি হারিয়ে দোয়ারাবাজার মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। অর্ধশতাধিক পরিবার পাশের সড়কের পাশে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যদের বাড়িতে উঠেছেন কেউ কেউ।
গত মঙ্গলবার রাতে মাজেরগাঁও গ্রামের সফিকুল ইসলাম, সমর আলী ভুট্টুসহ একই পরিবারের তিন ভাইয়ের ভিটে-মাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এর আগে গত রবি ও সোমবার দুইদিনে একই গ্রামের সামছুদ্দিন মিয়ার আধাপাকা বাড়িটি নদীগর্ভে গেছে। পুর্বমাছিমপুর গ্রামের অতুল দাস, রাজেন্দ্র দাস ও বাবুল দাসের ভিটেও নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। মুরাদপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা লালা মিয়ার বাড়িটি যে কোনো সময় তলিয়ে যাবে।
ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় আছে পূর্ব মাছিমপুর গ্রামের পিয়মন দাসসহ আরও ছয় পরিবারের বাড়ি। গত দুই দিনের ভারি বৃষ্টিতে ভাঙন বেড়েছে। মাজেরগাঁও গ্রামের সমর আলী ভুট্টু বলেন, এলাকার বড় বাড়িগুলোর একটি ছিল আমাদের। এখন মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই আমার পরিবারের।
মুরাদপুর গ্রামের সামছুদ্দিন বলেন, দুই দিনে দেখতে দেখতে আমার শত বছরের বসতি নদীগর্ভে গেল। গ্রামের বাসিন্দা মাজেদা বেগম বলেন, ‘শখের একটি বাড়ি তৈরি করেছিলাম, সেই বাড়িটি এখন নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে। আমার বাড়ির পেছনে অনেক বড় জায়গা ছিল, সেগুলো নদীতে তলিয়ে গেছে। এখন যে কোনো সময় আমার শখের বাড়িটিও নদীতে তলিয়ে যাবে। আমি সরকারের কাছে জোর দাবি জনাই, দ্রুত যাতে আমাদের ঘরবাড়িগুলো রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।’
গ্রামের বাসিন্দা আকাশ মিয়া বলেন, ‘আমাদের বাড়িঘর নদীভাঙন থেকে রক্ষা করতে সরকার ১৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু সেই টাকার কাজ এখনো শুরু হয়নি। ঠিক সময়ে যদি নদীভাঙন রোধে কাজ শুরু না হয় তারপর আর কাজ করে লাভ কী? এই নদীভাঙন কাজে দায়িত্বশীলরা অনেক অনিয়ম দুর্নীতি করছেন।’
গ্রামের বাসিন্দা রহমত মিয়া জানালেন, একসময় তার সব ছিল। নদীভাঙনে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছেন। সরকারের কাছে একটি ঘরের দাবি জানান তিনি।
সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান বলেন, দোয়ারাবাজারের নদীশাসনের জন্য ১৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। আবার নদী খননেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সিসি ব্লক বানানো চলছে। টার্গেট অনুযায়ী ব্লক বানানো শেষে আগামী শীত মৌসুমে পানি যখন কম থাকবে তখন ব্লক ফেলা এবং বিছানো হবে। এরমধ্যে প্রকল্প এলাকায় বড় ভাঙন দেখা দিলে ঠিকাদারকে দিয়ে ভাঙন নিয়ন্ত্রণের কাজ করা হবে।
গত কয়েকদিন ধরে ভয়াবহভাবে নদী ভাঙছে, কী উদ্যোগ নেয়া হবে জানতে চাইলে তিনি অপর নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুদ্দোহাকে ফোন করার কথা বলেন।
নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুদ্দোহা বলেন, ঠিকাদার এভাবে নদীভাঙন ঠেকানোর কাজ হয়তো করবে না। আমাদের ইমার্জেন্সি ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। এই বিষয়ে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শমসের আলী ভালো জানবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শমসের আলী বলেন, বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর ওখানে বোল্ডার ভেঙে কাটা পাথরই ব্যবহার করা হচ্ছে।
সাদা বালু না পেয়ে পরিষ্কার মোটা বালু ব্যবহার করার কথা জানিয়ে এই প্রকৌশলী আরও বলেন, কাজে অনিয়মের সুযোগ নেই। টাস্কফোর্স এসে বিষয়টি দেখে যে কোনো ব্লকই বুয়েটে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে পারে। পরীক্ষায় সঠিক পাওয়ার পরই ব্লক বিছানো বা ফেলার কাজ হবে।