১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২
কাউসার চৌধুরী (অতিথি প্রতিবেদক) : সিলেটে মোবাইল চোরাকারবারীরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গত মাসেও ধরা পড়েছে বড় আরেকটি চালান। গেল দু’বছরে ৫টি অভিযানে জব্দ করা হয়েছে সহস্রাধিক মোবাইল সেট। তবে মূল হোতারা সবসময়ই থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভারত থেকে অবৈধভাবে দেশে আসা এসব মোবাইল সেট উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হলেও আইনের আওতায় আসে না মূল চোরাকারবারীরা।
সিলেট জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. লুৎফুর রহমান জানিয়েছেন, চোরাচালান প্রতিরোধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় কঠোর নজরদারি রাখা হয়। চোরা কারবারীদের বিরুদ্ধে মামলাও হচ্ছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, একটি সংঘবদ্ধ চোরাকারবারী চক্র দীর্ঘদিন ধরে সিলেটের সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে ভারতীয় মোবাইল চোরাচালান দেশে নিয়ে আসছে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাচালানে আসা মোবাইল সেট সিলেট নগরীর মোবাইল মার্কেটগুলোতে পৌঁছে দেয়া হয়। এরপর চড়া দামে বিক্রি করা হয় এসব অবৈধ স্মার্ট ফোন। অবৈধ স্মার্ট ফোনের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খোঁজ না রাখায় চোরাকারবারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কেবল সিলেট নয়, চোরাচালানে আসা অবৈধ স্মার্ট ফোন চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে দিচ্ছে চোরাকারবারিরা। মধ্যে কয়েকমাস মোবাইল চোরাচালান আটকের খবর শোনা না গেলেও আবারও চোরাকারবারীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
মূলত ভারতের বিভিন্ন জায়গায় চুরি হওয়া মোবাইল ফোনগুলো চোরাকারবারীরা নিয়ে আসে। ভারতে চোরাইকৃত মোবাইল ফোনের আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি) বাংলাদেশে আসার পর আর শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। চোরাকারবারীরা এই সুযোগকে দীর্ঘদিন ধরে কাজে লাগাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
গত ২৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের বাইপাস সড়কের মুক্তিযোদ্ধা অফিসের সামনে সন্দেহজনকভাবে একটি মোটর সাইকেলকে ধাওয়া করে পুলিশ। মোটর সাইকেলে দু’ব্যক্তি ৩টি কার্টন নিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছিল। পুলিশের ধাওয়ায় কার্টন ৩টি রাস্তায় ফেলে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়। কার্টনগুলো উদ্ধারের পর খুলে দেখা যায় অত্যাধুনিক স্মার্ট ফোন। ৩ কার্টনে মোট ২০২টি স্মার্ট ফোন পাওয়া যায়। উদ্ধার হওয়া স্মার্ট ফোনের দাম প্রায় ৩০ লাখ টাকা। ভারত থেকে চোরাই পথে চোরাচালানিরা মোবাইল সেটের এই চালানটি অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে দেশের ভেতর নিয়ে আসে। এ ঘটনায় থানার উপ-পরিদর্শক মতিউর রহমান বাদী হয়ে গোয়াইনঘাট থানায় ওইদিন মামলা দায়ের করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, গোয়াইনঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামের লোকজন চোরাচালানিতে জড়িয়ে পড়েছেন। পান্তুমাই গ্রামের এক চোরাকারবারী এই মোবাইল চোরাচালান দেশে নিয়ে আসে। গোয়াইনঘাট থানার উপ-পরিদর্শক প্রলয় রায় মামলার তদন্ত করছেন। তবে, এই চোরাচালানের ঘটনায় এখনো কোনো চোরাকারবারীকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই শুক্রবার রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি দল গোপন সংবাদ পেয়ে চেকপোস্ট বসায়। চোরাকারবারীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাদের ধাওয়া করলে চোরাকারবারীরা গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাঘা এলাকায় নোহা মাইক্রোবাস রেখে দ্রুত পালিয়ে যায়। গোলাপগঞ্জ থানা পুলিশ এসে মাইক্রোবাসে তল্লাশি চালিয়ে ভারতে তৈরি বিভিন্ন ব্রান্ডের ৩১৬টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত মোবাইল চালানের দাম প্রায় ৮০ লাখ টাকা।
এর আগে ২৬ জুলাই সিলেট শহরতলীর মুরাদপুর এলাকা থেকে ৭১টি ভারতীয় চোরাই মোবাইল ফোনসহ বুখাইর আহমদ ও পলাশ নামের দু’জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। উদ্ধারকৃত মোবাইল ফোনের দাম প্রায় ১৮ লাখ টাকা।
এর আগে ওই বছরের ২২ জুন ভারত থেকে আসা ২৫টি স্মার্ট ফোনের চালানসহ জাকির হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় পুলিশ তার কাছ থেকে একটি প্রাইভেট কার জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর নগরীর কাজিটুলার মক্তব গলির ৪৪ নম্বর বাসার পঞ্চম তলা থেকে ৩টি কার্টন ভর্তি ভারতীয় স্যামসাং, ভিভো, অপ্পো ও এক্সজামিসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ২৭৯টি ভারতীয় চোরাই মোবাইল ফোন উদ্ধার করে পুলিশ। নগরীর সুবিদবাজার থেকে পুলিশের এএসআই জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে মোবাইলের বিশাল চোরাচালানসহ প্রাইভেটকার ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনায় খোদ পুলিশের অভ্যন্তরে তোলপাড় শুরু হয়। পরে অভিযান চালিয়ে এএসআই জাহাঙ্গীরসহ এ ঘটনায় জড়িত ৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সোবহানীঘাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক অনুপ কুমার চৌধুরী বাদী হয়ে ১৯ নভেম্বর কোতোয়ালি থানায় পৃথক মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে মূল চোরাকারবারীর নামসহ বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়। এজাহারে নাম থাকার পরও তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে চোরাকারবারীর নামই উল্লেখ করেননি।
সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে চোরাকারবারিরা সবসময় লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। স্মার্ট ফোন চোরাচালানে বহনকারীদের গ্রেফতার করা হলেও মূল হোতাদের গ্রেফতারে আর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।