১২ এপ্রিল ২০২২
তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি : সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার হাওরগুলোতে বোরো ধান পাকতে শুরু করেছে। সাপ্তাহ দশ দিনের মধ্যেই বোরো ফসল কাটার ধুম পড়বে। তবে হাওরে অকাল বন্যার পানি নামতে না নামতেই আরেকটি ঢল আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং অন্যান্য বৈশ্বিক আবহাওয়া সংস্থাসমূহের পূর্বাভাস অনুযায়ী ১০ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল, তদসংলগ্ন ভারতের আসাম এবং মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটার কয়েকটি পয়েন্টের পানি বিপদসীমানা অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে। ফের আবহাওয়া অধিদপ্তরের এমন পূর্বাভাসে আতঙ্কে দিন-রাত কাটাচ্ছেন হাওরাঞ্চলের কৃষকরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃক তাহিরপুর উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ফসল রক্ষা বাঁধ মেরামত ও সংস্কার করতে এবছর ৬৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) দ্বারা ৫৩ কিলোমিটার ডুবন্ত ফসলরক্ষা বাঁধ ও ১০টি ক্লোজার মেরামত করা হয়। এতে প্রাক্কলন ব্যায় ধরা হয়েছে ১২কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর এসব বাঁধের কাজ সময় মতো শুরু ও শেষ না হওয়ায় বাঁধ গুলো মজবুত হয় নি। ফলে বাঁধ দূর্বল থাকায় পাউবো’র ৬৮টি বাঁধেই ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় রয়েছেন হাওরপারের কৃষকরা। গত এক সাপ্তাহের ব্যবধানে উপজেলার নজরখালীর বাঁধ ভেঙে টাংগুয়ার হাওর, এরালিয়াকোনা, গুন্নাকুড়ি হাওরের প্রায় ৭ হাজার হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে গেছে। অবশিষ্ট বাঁধ গুলো রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা। বিভিন্ন বাঁধে ধস ও ফাটল দিখা দিচ্ছে। আর বাঁধের ধসে পড়া ও ফাটলের স্থানে বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন স্থানীয় কৃষকসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
এদিকে, মাঘ মাসের শেষের দিকে স্থানীয়রা তাহিরপুর উপজেলার মহালিয়া হাওরের ময়নাখালি বিল সেচে মাছ ধরায় বর্তমানে ঝুঁকিতে রয়েছে ময়নাখালি বাঁধটি। যেকোনো মুহুর্তে ঘটে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। বাঁধ রক্ষা করতে বাঁশ, বস্তা ও ধারি প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্থানীয় কৃষকরা। তবে বাঁধে প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম দেখা মিলছে সংশ্লিষ্ট পিআইসি কমিটির সভাপতিসহ সদস্যের। ফলে বোরো ফসল রক্ষা হবে কি না? তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন মহালিয়া হাওরের কৃষকরা।
এদিকে, বাঁধ ভেঙে কৃষকের ক্ষতি হলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) নামে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক দলের নেতারা গরিব কৃষকদের নাম ব্যবহার করে প্রকল্প নিয়ে সরকারি টাকা লুটপাট করে লাভবান হয়েছেন, এমন অভিযোগের পাহাড় এখন হাওরাঞ্চলের সর্বত্রই। হাওরে ফসলহানি ও বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদে ও পিআইসিদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন তাহিরপুরে হাওর বাঁচাও আন্দোলন কমিটি।
তাহিরপুর উপজেলা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, টাংগুয়া হাওরসংলগ্ন গনিয়াকুড়ি, এরালিয়াকোনা, নান্দিয়া, লামারগুল, টানেরগুল, রাঙ্গামাটিয়া, ফলিয়ার বিল, সন্যাসি এসব হাওরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো প্রকল্প নেই। এসব হাওর বোরো ধান চাষ করা কৃষকরা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় সময় পার করছে। বাকি বাঁধ গুলো রক্ষা করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ হাসান উদ দৌলা জানায়, এবার ছোট বড় ২৩টি হাওরে বোরো জমি চাষ করেছেন কৃষকরা ১৭,৪৯৫ হাজার হেক্টর। এথেকে চাল উৎপাদন হবে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। আমরা সার্বক্ষণিক খবর রাখছি বাঁধের বিষয়ে। এ পর্যন্ত পানিতে ডুবে যাওয়া ৩টি হাওরের বোরো ধান নিমোজ্জিত ১ শত হেক্টর আছে।
হাওরাঞ্চলে কৃষক ও কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিতরা জানায়, ঠিকাদারের পর পিআইসিও কার্যত ব্যর্থ। অনেক জায়গায় অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণের ফলে উল্টো হাওরের প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে। আর এসব পিআইসি গঠনেও কৃষকদের চেয়ে রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তারা নিজদের ফায়দা হাসিল করেছেন। পিআইসি সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে ভবিষ্যতে কেউ বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি-অনিয়ম করার সাহস পাবে না বলে দাবি করেন।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের তাহিরপুর উপজেলা শাখার নেতা সাইদুল কিবরিয়া বলেন, হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে অর্থ বরাদ্দ বহুগুণ বেড়েছে। বেড়েছে বাঁধের দৈর্ঘ্য ও উচ্চতাও। কিন্তু দুর্বল বাঁধ ও ক্লোজারে (খাল) যথাযথ নিয়মে কাজ না হওয়ার কারণেই হাওরে উৎপাদিত একমাত্র বোরো ধান এখন ঝুঁকিতে পড়েছে। এ ক্ষতির দায় পাউবোকেই নিতে হবে।
তাহিরপুর উপজেলার বৃহত্তর শনির হাওরের পাড়ের কৃষক মুশাহিনসহ একাধিক কৃষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখনো ধান কাটতে পারিনি। পানি বাড়ছে। বাঁধ দুর্ভল। তাই এখন আমরা বাঁধ ভাঙার আতঙ্কের মাঝে আছি। অথচ সরকার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। সঠিকভাবে বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় আমাদের বাঁধ ভাঙ্গার আতঙ্কে রাত পার করতে হয়। বাঁধ মেরামতে কাজ করতে হয়। পিআইসি ও পাউবোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
তাহিরপুর উপজেলা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রায়হান কবির জানান, বাঁধ নির্মাণে অনিয়মকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। বাঁধ টিকিয়ে রাখতে সবোচ্চ চেষ্টা করছি। আশা করছি কৃষকদের আর কোনো ক্ষতি হবে না।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল জানান, প্রতিটি বাঁধ রক্ষায় প্রশাসনসহ সর্বস্তরের মানুষ কাজ করছেন। বাঁধগুলো এখনো টিকিয়ে রেখেছেন তারা। আমি নিজেও বাঁধ তদারকি করছি। কৃষকসহ সবাইকে হাওরের ফসল রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছি। তবে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও গাফিলতি যারা করেছে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।