১০ জুন ২০২২
আজকের সিলেট ডেস্ক : একদিকে মহামারি করোনার ধাক্কা, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। এমনই এক সঙ্কটময় মুহূর্তে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি জনজীবনে স্বস্তি ফেরাতে বিশাল প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জের বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যদিও রেকর্ড ঘাটতির এই বাজেট প্রস্তাবনায় করোনা মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে নতুন কোনো প্রস্তাব আসেনি।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে সেই সংকট কাটিয়ে নতুন উদ্দীপনা আনতে ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং নগদ ঋণ খাতে ব্যয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এর মাধ্যমে চলমান অর্থনীতি, উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী তথা ক্রেতা-ভোক্তার সক্ষমতার উন্নয়ন করাই সরকারের লক্ষ্য।
‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এই ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। আর মূল বাজেটের চেয়ে এটি ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই বাজেটে আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। যা বাস্তবায়নে নির্ভর করতে হবে বড় অঙ্কের ঋণের ওপর।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যের সাম্প্রতিক যে গতি-প্রকৃতি, তাতে ভর্তুকি ব্যয় ১৫-২০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা বাজেট বাস্তবায়নে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং নগদ ঋণ বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব বৈশ্বিক ঝুঁকি থেকে অর্থনীতিতে নতুন করে উদ্দীপনা জোগাবে। এটা একদিকে দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় যেমন কাজ করবে, তেমনি উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে জনগণকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপ থেকেও স্বস্তি দেয়া সম্ভব হবে।
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আগামী বছর সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতা সম্প্রসারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, সব সময় নিম্ন-আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারবদ্ধ এ সরকার আগামীতেও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতা সম্প্রসারণ করবে। সে ধারাবাহিকতায় নিম্ন-আয়ের মানুষের মাঝে স্বল্পমূল্যে এমনকি বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। আগামী বাজেটে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সফল বাস্তবায়ন আমাদের সরকারের অগ্রাধিকারের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি ও রপ্তানি বহুমুখীকরণ, কর্মসৃজন ও পল্লী উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতা সম্প্রসারণে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর উপস্থাপন করা প্রস্তাবিত ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় করা হবে ৭৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। পণ্য ও সেবার জন্য ব্যয় করা হবে ৩৮ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। এছাড়া ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৮০ হাজার ২৭৫ কোটি। ভর্তুকি প্রণোদনা ও নগদ ঋণ বাবদ ১ লাখ ৭৭ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) খরচ করা হবে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৭ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে ২ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা খরচ করা হবে।
প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কর থেকে পাওয়া যাবে ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। কর ব্যতীত অন্যান্য খাত থেকে আদায় হবে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি অনুদান পাওয়া যাবে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এই ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ৫ হাজার ১ কোটি টাকা আসবে অন্য উৎস থেকে। বিদেশি ঋণ থেকে আসবে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকি প্রণোদনা এবং ঋণ বাবদ রাখা হয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য বাবদ খাদ্য ভর্তুকির জন্য রাখা হয়েছে ৬ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকিতে ব্যয় হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাতে ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মোট ভর্তুকির পরিমাণ ৪২ হাজার ৪৫ কোটি টাকা।
বাজেটে কৃষকদের উৎসাহিত করতে কৃষি খাতে এবার দেশে রেকর্ড ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও বীজে প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন ও সারে ভর্তুকিতে এ টাকা খরচ করা হবে।
কৃষিতে প্রণোদনার জন্য রাখা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। পাটজাত দ্রব্যে প্রণোদনার জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। প্রবাস আয় বা রেমিট্যান্সের প্রণোদনার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর সামাজিক সুরক্ষায় মোট ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। এবার এ খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। গত বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। সে তুলনায় এ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে চার হাজার ১৩২ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা খাতে ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য অনুদান বরাদ্দ থাকছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৮ হাজার ২২১ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামী বাজেটে তিন হাজার ৫৪০ বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
নতুন অর্থবছরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য চার হাজার ২৯০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ছিল ৪ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এই খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ১০০ কোটি টাকা। নারীর ক্ষমতায়ন ও শিশু কল্যাণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগামী বাজেটে পাঁচটি ব্যয় খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে, দুঃস্থ মাতাদের খাদ্য সহায়তা (ভিজিডি) কর্মসূচি, জীবন-চক্রভিত্তিক মাদার অ্যান্ড চাইল্ড বেনিফিট প্রোগ্রাম, শিশু বিকাশ কেন্দ্র ও কিশোর-কিশোরীদের ক্ষমতায়ন কর্মসূচি, নারীদের জন্য কারিগরি, বৃত্তিমূলক, আয়বর্ধক ও উৎপাদনশীল প্রশিক্ষণ ও নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ ও আইনগত সহায়তা দেওয়া।
আগামী অর্থবছরে ৮ লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর বৈদেশিক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা এবং ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষের বিভিন্ন ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রবাসী ও প্রবাস হতে প্রত্যাগত কর্মীদের কল্যাণে নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে। অভিবাসনে পিছিয়েপড়া দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ সমগ্র দেশ থেকে অধিকহারে অভিবাসনে উৎসাহী করার লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে দেশের সব উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া নতুন অর্থবছরে ৮ লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর বৈদেশিক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার এবং ৫ লাখ ২০ হাজার জনকে বিভিন্ন ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য কোনো সুখবর দেননি অর্থমন্ত্রী। তাদের জন্য নতুন পে-স্কেল বা নবম বেতন কাঠামো ঘোষণা হয়নি।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।