২৭ জুন ২০২২
নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘পানি তো কইম্মা গ্যাছে। কিন্তু অহনে কী করমু? খাইয়া-না খাইয়া ৯ দিন আছিলাম আশ্রয়কেন্দ্রে। কাইলকা বাইত (বাড়িত) আইয়া দ্যাহি পাইন্নে ঘর দুয়ার ভাইঙা দিছে। অহনে কাম করামু ক্যামনে,আর খামুই বা কী?’ কথাগুলো বলছিলেন মালেকা বেগম। বাড়ি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে। ধীর গতিতে বানের পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে কাল নিজ বাড়ি ফিরেন তিনি। বাড়ি ফিরে আরও অসহায় মালেকা বেগম। দ্বিতীয় দফার বন্যায় মালেকা বেগমের নিজের সামান্য কৃষি জমির ধানও তলিয়ে যায়। স্বামী আর পাঁচ সন্তান নিয়ে একেবারেই নিরুপায় মালেকা বেগম। নতুন করে ঘরবাড়ি মেরামত করা তো দূরের কথা, হাতে একটি কড়িও নেই তাদের। এই অসহায়ত্ব শুধু দোয়ারাবাজারের মালেকা বেগমের একার নয়। সিলেট এবং সুনামগঞ্জের অন্তত ১৩ উপজেলার আরও অনেকের।
এর আগে আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারি ত্রাণ না পেলেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শুকনো খাবারে কোনোমতে বেঁচে ছিলেন তারা। কোনোদিন রান্না করা খাবারও মিলছে। কিন্তু অর্থাভাবে বাড়িঘর মেরামত করতে পারছেন না শ্রমজীবী মানুষগুলো। নগরী থেকে ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে হাওর ও নদীতীরের গ্রামগুলোর মানুষ লড়াই করেই টিকে আছেন। এবারের ভয়াবহ বন্যা তাদের আরও অসহায় করে তুলেছে।
দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পৈত্যপাড়ার বাসিন্দা দীগেন সূত্রধর। বাড়িতে চার সন্তান নিয়ে থাকেন তিনি। ছোট সন্তানকে নিয়ে চার দিন ঘরে আটকে থাকার কথা বলছিলেন এভাবে, ‘ঘরে গলাপানি, নৌকা নাই। খালি কান্দিছি। পরে মাইনষে নৌকা লইয়া আইয়া বাইর করছইন।’ এক সপ্তাহের মতো বাড়ির পাশে উঁচু রাস্তায় ত্রিপলের নিচে পরিবারসহ শতাধিক মানুষের সঙ্গে ছিলেন তিনি।
এদিকে সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি কমছে খুবই ধীরগতিতে। ফলে প্লাবিত এলাকার বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট থেকে পানি নামছে ধীরে ধীরে। তাই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে ফিরতে শুরু করেছেন বানভাসি মানুষ। কিন্তু বাড়ি ফিরে ফের চোখে মুখে হতাশা তাদের। ভারী বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও হাওরের ঝোড়ো বাতাসে অনেকের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। সরকারি সহযোগিতা না পেলে ঘরবাড়ি ঠিক করার কোনো উপায় নেই তাদের।
এই অসহায় মানুষগুলো কবে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা পাবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। গত মাসের মাঝামাঝিতে সিলেটে ভয়াবহ বন্যায় সরকারি হিসাবেই ৮৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। সেই সময়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা হলেও কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি। এবারের বন্যার ভয়াবহতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ফলে ক্ষয়ক্ষতিও বেশি হবে। গতকাল পর্যন্ত সরকারি হিসাবে জেলায় বন্যায় ৩ লাখ ৮৯ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্তত ২২ হাজার ঘরবাড়ি এবং প্রায় ২৯ হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, অতীতে বন্যা বা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অগ্রিম বরাদ্দ হতো। এখন ‘ড্যামেজ অ্যান্ড নিড অ্যাসেসমেন্ট’ কর্মসূচির আওতায় ২৭ খাতে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করার পর ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা অনুযায়ী মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হয়। এখনও তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়নি। মে মাসের মাঝামাঝিতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা পাঠানো হলেও সেই বরাদ্দ এখনও আসেনি।
গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বন্যার্ত ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ ঘরবাড়িতে ফিরেছেন বলে জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে। তবে এখনও ৭১ হাজারের বেশি বানভাসি মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।