
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটেছে এবার। পাসের হার ও জিপিএ-৫—দুটোতেই একসঙ্গে ধস নেমেছে। গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার প্রায় অর্ধেক। আর জিপিএ-৫ কমেছে প্রায় পাঁচগুণ। যা ফলাফলে বড় ধাক্কা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফল বিপর্যয়ের পেছনে রয়েছে শিক্ষাবোর্ডগুলোর ‘পলিসি মেকিং’ ও শিক্ষার্থীদের দুর্বল ভিত্তি। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় অমনোযোগিতা ও অভিভাবকদের উদাসীনতা। বিশেষ করে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের মধ্যে সংকট একটি বড় কারণ।
সিলেট শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরীও বলেছেন, এবারের ফলাফল হচ্ছে সিলেটের বাস্তব চিত্র। এবার শিক্ষকরা স্বাধীনভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে পেরেছেন। কোনো ধরনের চাপ ছাড়াই সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার কারণে ফলাফল নেমেছে। তবে এর বাইরে শিক্ষার্থীদের অমনোযোগিতা ও অভিভাবকদের উদাসীনতাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এবছর সিলেট শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ৬৯ হাজার ১৭২ জন। তাদের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৩৫ হাজার ৮৭১ জন। পাসের হার ৫১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। যা বিগত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক হাজার ৬০২ জন। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ছয় হাজার ৬৯৮ জন শিক্ষার্থী।
ফলাফল বিপর্যয়ের পেছনে সঠিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের অভাব, দুর্বল শিক্ষার্থী ও ৫ আগস্টের পর শিক্ষার্থীদের ভিন্ন চিন্তাধারাসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
শিক্ষকরা বলছেন, ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণিতে অটোপাসের মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এই বছরগুলোতে তাদের পাঠদান ছিল অনিয়মিত, অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ ছিল সীমিত, আর বাস্তব মূল্যায়নের সুযোগও ছিল না। এই শিক্ষার্থীরাই পরে ২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন, যেখানে বোর্ড কর্তৃপক্ষ নম্বর প্রদানে নমনীয়তা দেখায়। ফলে অনেকেই ভালো ফল করলেও তাদের শক্ত ভিত তৈরি হয়নি।
তারা আরও বলছেন, ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষাতেও প্রশ্ন ছিল তুলনামূলক সহজ ও উত্তরপত্র মূল্যায়নে ছিল নমনীয়তা। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন কঠিন হওয়ায় এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নে কোনো নমনীয়তা না দেখানোয় এই শিক্ষার্থীরাই খারাপ ফলাফল করেছেন।
শিক্ষাবিদ আবুল ফতেহ ফাত্তাহ বলেন, ‘আমার মতে ফলাফল কোনো সময় বিপর্যয় হয় না। ফলাফল প্রণয়নে সব বোর্ড মিলে যে পলিসি তৈরি করে, সে পলিসিতে শিক্ষার্থীদের মেধার সঙ্গে ও মানবিক দিকটি বিবেচনা করা হয়। যখন উদার পলিসি অনুসরণ করা হয়, তখন ফলাফল বেশ ভালো হয়। যখন একটু কঠোর হয়, তখন ফলাফল নেমে আসে।’
ফলাফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ শিক্ষানীতিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বলে মনে করেন মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল আনাম মো. রিয়াজ। তিনি বলেন, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ও শিক্ষা উপদেষ্টা দুজনই শিক্ষক। তাদের সময়ে এটা আশা করা যায়নি। এই সরকারের আমলে অন্তত শিক্ষানীতিটা ঠিক করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
কিনি অধ্যাপক বলেন, ৫৪ বছর ধরে আমরা শুনে আসছি শিক্ষাব্যবস্থা ঢালাওভাবে সাজানো হবে। কিন্তু কখন সাজানো হবে তা আমরা জানি না।
সিলেট শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘সিলেটে এবছর যে ফলাফলটা এসেছে এই সিলেটের বাস্তব চিত্র। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যায় না, ইংরেজিতে ভালো করে বোঝে না। যার কারণে ফল খারাপ হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের সম্পর্কটা আগের মতো নেই। একজন শিক্ষার্থী একজন শিক্ষককে নির্দেশ দিচ্ছে, তাহলে একজন শিক্ষক কীভাবে পাঠদান দেবেন?’
এবারের ফলাফল ইংরেজিতে খারাপ বেশি। দুই পত্র মিলিয়ে ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে জানিয়ে বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের বড় সমস্যা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নেই। গেল ১০ থেকে ১২ বছর ধরে শিক্ষকদের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। ফলাফল বিপর্যয়ে এটিও একটি কারণ।’
আজকের সিলেট/ডি/এসটি
