দিন দিন জোরালো হচ্ছে পাথর কোয়ারি খুলে দেয়ার দাবি
মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১২

দিন দিন জোরালো হচ্ছে পাথর কোয়ারি খুলে দেয়ার দাবি

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৬/১০/২০২৪ ১১:২৭:৫৩

দিন দিন জোরালো হচ্ছে পাথর কোয়ারি খুলে দেয়ার দাবি


সিলেট অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের মতে, স্থানীয় অর্থনীতির মজুবত ভিত্তি হচ্ছে পাথর কোয়ারি। এবার সেই কোয়ারিগুলো থেকে পরিবেশ সম্মতভাবে পাথর উত্তোলনের সুযোগ করে দেয়া জরুরী। এই দাবি কোয়ারি অধ্যুষিত এলাকাগুলোর বাসিন্দাদেরও। তাদের দাবি, কয়েক বছর কোয়ারি বন্ধ থাকা ও পাথর উত্তোলন না করায় নদীর প্রবেশমুখে স্তুপাকারে আটকে আছে পাথর। এতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে।

অন্যদিকে, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাথর লুটপাট অব্যাহত রয়েছে। এতে সরকারও বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া কোয়ারি বন্ধ থাকায় বেকার হয়েছেন প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক। মানবেতর জীবনযাপন করছেন কোয়ারির সাথে জড়িত পাথর ও পরিবহন ব্যবসায়ী, বেলচা, বারকি, পরিবহন ও লোড-আনলোড শ্রমিকরা। এই ইস্যুতে স্থানীয়ভাবে আন্দোলন জোরালো হচ্ছে।

সীমান্ত ঘেঁষা সিলেট বিভাগের চার জেলার অন্তত ১০/১২টি এলাকায় ভারত থেকে বয়ে আসা নদ নদীর উৎসমুখে রয়েছে বিশাল পাথরের ভান্ডার। এর মধ্যে সিলেটের ভোলাগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, বিছনাকান্দি, লোভাছড়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, শ্রীপুর অন্যতম। ব্যবসায়ীদের অভিমত, স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকে সারা দেশের পাথর সরবরাহ করা হয়ে আসছিল ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, জাফলং এবং লোভাছড়া পাথর কোয়ারি থেকে।

কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে সিলেট অঞ্চলের সবকটি কোয়ারি থেকে বন্ধ রয়েছে পাথর উত্তোলন। এর ফলে কোয়ারি নির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে অচলাবস্থা থাকায় ব্যবসায়ীরা হয়ে গেছেন দেউলিয়া। শ্রমিকরা হয়ে পড়েছেন কর্মহীন।

বিশেষ করে সিলেটের ট্রাক মালিক ও শ্রমিকদের ব্যবসায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অধিকাংশ ট্রাক মালিক ব্যাংক ঋণ নিয়ে অথবা কোম্পানীগুলোর কাছ থেকে কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের শর্তে তাদের গাড়ী কিনেছেন। গত ৬ বছর ধরে কোয়ারি বন্ধ থাকার কারণে ট্রাক মালিকদের পণ্য পরিবহনে ভাটা পড়ে। অনেক মালিক ঋণের কিস্তি দিতে না পেরে ইতোমধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকেই ব্যাংক ঋণে জর্জরিত হয়ে চরম আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়েছেন। ব্যাংক লোন থাকায় অনেকের ঘরবাড়ি নিলামে উঠে গেছে।

পাথর পরিবহন বন্ধ থাকায় বিপুল সংখ্যক ট্রাক মালিক, স্টোন ক্রাশার মালিক ও ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণে জর্জরিত হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় দিন যাপন করছেন।

পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা আরো দাবি করেন, সনাতন পদ্ধতিতে পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার জন্য হাইকোর্ট একাধিক বার নির্দেশনা দেন। ২০২২ সালের নভেম্বর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ নায়েব আলীর নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারি পরিদর্শন করে। এরপর তারা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে শর্তসাপেক্ষে পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়া হতে পারে মর্মে মত দেওয়া হয়। কিন্তু, পরে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। অথচ, পাথর কোয়ারি বন্ধ রেখে বিদেশ থেকে রিজার্ভের ডলার খরচ করে পাথর আমদানী করে উন্নয়ন কাজ চালানো হয়। ফলে রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ সংকটে নিপতিত হয়েছে। লাখো মানুষের জীবন রক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় রিজার্ভের ডলার সাশ্রয়ের জন্য সিলেটের পাথর কোয়ারী জরুরী ভিত্তিতে খুলে দেয়ার দাবী তোলা হয়।

এদিকে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, ছাতক, তাহিরপুর, কানাইঘাটে সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার ক্রাশার মিল বন্ধ। পাথর উত্তোলন বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে সেই মিলগুলোও বন্ধ হয়ে যায়।

যেসব ব্যবসায়ী আগে থেকেই আমদানি-রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের অনেকে জড়িয়ে পড়েন পাথর আমদানিতে। তামাবিল স্থলবন্দরসহ সিলেটের সব শুল্ক স্টেশন দিয়ে শুরু হয়েছে ভারত থেকে পাথর আমদানি। আমদানি করা বোল্ডার (বড়) পাথর ভেঙে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করছিলেন মিল মালিকরা। তবে এই পাথরের মানও নিম্নমানের।

অপরদিকে, দীর্ঘদিন থেকে পাথর কোয়ারি খুলে দেয়ার দাবিতে বৃহত্তর সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ঐক্য পরিষদের ব্যানারে নানা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পাথর কোয়ারী খুলে দেয়ার দাবীতে হরতাল, পরিবহন ধর্মঘট, মিছিল সমাবেশ, মানববন্ধনসহ কর্মসূচির পর কর্মসূচি পালন করেছেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু, কিছুতেই নড়েনি সংশ্লিষ্টরা। সনাতন পদ্ধতিতে পাথর কোয়ারি খুলে দেয়ার দাবীতে ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে সিলেটে ৪৮ ঘন্টার পরিবহণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল সিলেট বিভাগীয় ট্রাক পিকআপ কার্ভাডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। কিন্তু কাজে আসেনি।

এমনকি ২০২২ সালের ৩১ মে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগে পাথর কোয়ারিগুলো খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর চার মাস পর ডিও লেটার দেন বতর্মানে কারান্তরীন সাবেক সংসদ সদস্য, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। কিন্তু, সিদ্ধান্তের পর প্রায় ২ বছরে বেশি সময় পার হলেও খুলে দেয়ার ব্যাপারে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত হয়নি। অবশ্য এই ডিও লেটারকে মন্ত্রীর নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্ট্যান্ডবাজি ছিল বলে মন্তব্য করেন ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিনে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক বছর কোয়ারি বন্ধ থাকায় ও পাথর উত্তোলন না করায় বর্তমানে অনেক পাথর নদীর প্রবেশমুখে স্তুপাকারে আটকে আছে। নদীর প্রবেশমুখে পাথরের স্তুপ থাকায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ায় জাফলং কোয়ারির পাশে খাসিয়াপুঞ্জি, বিছনাকান্দি কোয়ারির পাশে বগাইয়া, ভোলাগঞ্জ কোয়ারির কালাইরাগ, কালাসাদক মৌজাসহ নদীর আশপাশের গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে এবং এলাকাগুলো নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পাথর কোয়ারির প্রবেশমুখগুলো উন্মুক্ত করার জন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে পাথর উত্তোলনের অনুমতি দিলে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিসহ নদীর পানি প্রবাহ ঠিক থাকবে। নির্মাণ সামগ্রীর অন্যতম উপকরণ পাথরের দাম দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে এবং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা মনে করেন, কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের অনুমতি দিলে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

বৃহত্তর সিলেট পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সমন্বয়ক শাব্বির আহমদ দাবি করেন, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সিলেটের সব পাথর কোয়ারি বন্ধ করে দিয়ে বিদেশ থেকে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অপচয়ের মাধ্যমে পাথর আমদানি শুরু করে। কোয়ারি বন্ধ করে দেওয়ায় এ অঞ্চলের লাখো মানুষের জীবন-জীবিকায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।

তিনি বলেন, বিগত সরকার ভারত ও সিন্ডিকেটের স্বার্থে পাথর কোয়ারি বন্ধ রেখেছিল। এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের চাহিদার কথা চিন্তা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কোয়ারি খুলে দেয়া জরুরী।

সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল জলিল বলেন, আমরা মনে করি যন্ত্র ব্যবহার না করে হাত দিয়ে পাথর উত্তোলনে পরিবেশের ক্ষতি হবে না। কোয়ারি বন্ধ থাকায় পাহাড়ি ঢলে অনেক পাথর ও বালু জমাট হয়ে আছে। বৃহত্তর কোয়ারি ভোলাগঞ্জ ৭০০ একর ও জাফলং কোয়ারি ২১৩ একরজুড়ে। এই দুই কোয়ারিতে দুই লক্ষাধিক শ্রমিক ও ব্যবসায়ী যুক্ত ছিলেন। সব মিলিয়ে ৬-৭ লাখ লোক কোয়ারিগুলোতে যুক্ত ছিলেন। তারা বেকার হয়ে গেছেন। শত শত ক্রাশার মিলও বন্ধ। লোভাছড়ায়ও একই পরিস্থিতি। পাথর উত্তোলন না করায় পাথরের স্তুপ জমে আছে। আব্দুল জলিল বলেন, দ্রুত পাথর কোয়ারি খুলে না দিলে সীমান্তের মানুষ শ্রমিক জনতাকে নিয়ে পথে নামতে বাধ্য হবে।

সিলেটের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সিলেট চেম্বার এন্ড কমার্স ইন্ড্রাস্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুজিবুর রহমান মিন্টু বলেন, সিলেটের পাথর কোয়ারি সমুহ খুলে দেয়ার দাবি দীর্ঘদিনের। কারণ কোয়ারি বন্ধ থাকার কারণে বছরের পর বছর থেকে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন সিলেটের ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করতে চান। সিলেট চেম্বার বরাবরের মত কোয়ারি খুলে দেয়ার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে।আশা করি সরকার দ্রুত কোন পদক্ষেপ নিবে।

তবে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, সরকারি গেজেটের মাধ্যমে কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়েছে। এখানে জেলা প্রশাসনের কিছু করার নিয়ে। সম্পূর্ণ বিষয়টি মন্ত্রণালয় দেখে। আমরা যে নির্দেশনা পাবো, সেটি বাস্তবায়ন করবো। এর বাইরে কোয়ারি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।

আজকের সিলেট/ডি/এসটি

সিলেটজুড়ে


মহানগর