আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে একের পর এক পরাস্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এরমধ্যে পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে পাত্তা পায়নি বিএনপি। এমন বাস্তবতায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে দলটি। আসন্ন উপজেলাসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশন এবং পৌর নির্বাচনে অংশ নেয়া ইস্যুতে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকলেও দলের নির্বাহী কমিটির পর্যালোচনা সভার মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি উঠেছে।
দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা থাকলেও সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের বৈঠকে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। ওই বৈঠকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেরে পর সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। সেরেছে সকল আনুষ্ঠানিকতা। এরই মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে সংসদের প্রথম অধিবেশনও। সম্প্রতি ৪৮৫টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন। গত ১৬ জানুয়ারি ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের জানান, ধাপে ধাপে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রোজার আগেই প্রথম ধাপের নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া আগামী ৯ মার্চ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন হবে। একই দিনে কয়েকটি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে তফসিল ঘোষণা করা হবে। ইতোমধ্যে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন শুরু হয়। বিএনপি ২০২১ সালের মার্চের পর থেকে স্থানীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। বরং দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তৃণমূলের অনেক নেতাকে বহিষ্কার করে বিএনপি। এর মধ্যে ২০২২ সালে বিএনপির তৈমূর আলম খন্দকার ও মনিরুল হক সাক্কু নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে দল থেকে তাদের বহিষ্কারের ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন ইস্যুতে দলটির সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে তাদের ১০ সাংগঠনিক জেলার প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মীর সঙ্গে আলাপ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে তিন ধরনের মতামত পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে-বিপক্ষে যেমন রয়েছে, পাশাপাশি এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দলের নির্বাহী কমিটির পর্যালোচনা সভার তাগিদ রয়েছে। তবে এসব নিয়ে অধিকাংশ নেতাকর্মী তাদের নাম পদবী প্রকাশ করতে চান না।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে যেসব দাবি উঠেছে তা হলো
ক. সরকার বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হলে অন্তত দুইশো উপজেলায় চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জয় লাভ করার মতন ক্যাপাসিটি এখনো দলের রয়েছে।
খ. সরকার বিরোধী আন্দোলন যদি বেগবান করা না যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা যদি আন্দোলনের পক্ষে না থাকে সেক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে হলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়া উচিত।
গ. স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিভক্তি বিএনপির প্রার্থীর জন্য সহায়ক হবে।
ঘ. স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ না নিলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কেউ অন্যান্য রাজনৈতিক দলে যোগ দেবে, কেউ পেশাজীবী হয়ে যাবে। মূলত সবাই রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। বিএনপির মূল শক্তি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী। তারা বিলীন হয়ে গেলে বিএনপিকে ভবিষ্যতে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হবে।
ঙ. তিনটি জাতীয় নির্বাচনে হারার পর এখন তৃণমূল পর্যায়ের দলীয় নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে হলে স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিকল্প নেই।
চ. বিএনপির হাই কমান্ডের নমনীয় থাকা উচিত। যেহেতু দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে না- তাই যাদের ক্যাপাসিটি আছে তারা নির্বাচন করলে প্রকাশ্য না হলেও অভ্যন্তরীণভাবে দল থেকে উৎসাহ দেয়া উচিত। দল আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও অন্তত ৫০ উপজেলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মানসিকতা রয়েছে।
ছ. স্থানীয় নির্বাচনে যেহেতু সরকারের পরিবর্তন হয় না- তাই আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়া উচিত। নির্বাচনে গেলে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পাবেন যা চলমান আন্দোলনকে আরো গতিশীল করবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিপক্ষের দাবি
ক. দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর এই নির্বাচনের অংশ নিলে তাতে বিএনপির নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং সেটা সরকারের প্রতি সমর্থন জানানো হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিএনপি জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেবে না।
খ. পুরো প্রশাসন আওয়ামীকরণ হয়ে আছে। প্রার্থী যারাই হোক না কেন নির্ধারিত ব্যক্তিরাই নির্বাচিত হবেন। তাদের নির্ধারিত নির্বাচনে ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সরদার হয়ে লাভ নেই।
গ. ইতিপূর্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য অনেকেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের কাছে দল কী জবাব দিবে?
ঘ. বর্তমান পরিস্থিতিতে সারাদেশের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে রয়েছেন। নির্বাচনে অংশ নিলে নেতাকর্মীদের উপর মামলা-হামলা আরো বাড়বে। বিএনপি নেতাকর্মীদের পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ঙ. উপজেলা নির্বাচনে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা খরচ হয়। এই খরচ করার সামর্থ্য এই মুহূর্তে বিএনপি নেতা কর্মীদের নেই। তাই অনর্থক নেতাকর্মীদের হয়রানির শিকার করতে নির্বাচনে অংশ নেয়া উচিত নয়।
চ. বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে যা সরকারের পতন ত্বরান্বিত করবে- যদি দলের হাইকমান্ডের কাছে এমন কোন সুনির্দিষ্ট বার্তা থেকে থাকে তাহলে আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়া উচিত হবে না।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে নির্বাহী কমিটির পর্যালোচনার পক্ষের মত
পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যর্থ হওয়ার পর এখন জরুরিভাবে নির্বাহী কমিটির সাধারণ সভা আহ্বান করা উচিত। সেটা তিন দিনব্যাপী বা সাত দিনব্যাপী হোক। সকল নেতাকর্মী তাদের পূর্ণাঙ্গ মতামত প্রকাশ করবেন। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার মাধ্যমে নির্বাচনী অংশ নিয়ে এর পক্ষের মত যদি বেশি হয় সে ক্ষেত্রে দলের অংশ নেয়া উচিত আর যদি অংশ না নেওয়ার পক্ষের দল ভারী হয় তবে বিরত থাকা উচিত।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মুহাম্মাদ রহমাতউল্লাহ বিবার্তাকে বলেন, 'স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সব ধরনের আলোচনা নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে। প্রার্থীদের মধ্যে কিছু রয়েছেন যারা হারজিত যাই হোক না কেন তারা নির্বাচনে অংশ নিতে চান। কিন্তু অধিকাংশ সাধারণ নেতাকর্মী এই নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিপক্ষে। তারা মনে করছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, নির্বাচনে নেতাকর্মীদের হয়রানি বাড়বে। অন্যদিকে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে মর্মে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। নানান আলোচনায় রয়েছে।'
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন কখনোই শান্তিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু হবে না। সুতরাং তার অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না, সেই সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া আছে। বিএনপি এখনো সেই সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে।’
উপজেলা পরিষদের ভোটে দলীয় প্রতীক নৌকা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সে ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন হলে বিএনপি কী করবে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এই সরকারের অধীনে নির্বাচনই তো সুষ্ঠু হয় না। সেখানে দলীয় প্রতীক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।’
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, দেখেন উপজেলা নির্বাচনে যেহেতু ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, সরকারের কিছু আসে যায় না আমরা সেই নির্বাচনে যেতেও চাই না। নির্বাচনে গেলে তো ২০১৪ সালে আমরা ক্ষমতায় আসতাম। ১৮ তে গেলাম এই সরকারকে বিশ্বাস করে- আমাদের জবাই করে দিলো। এদের আর বিশ্বাস করা যায় না। তাদের কোন পাতানো নির্বাচনেই আর যাবো না। আমরা গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য লড়াই করছি। সেই লড়াই চালিয়ে যাব।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান বলেন, এই সরকারের অধীনে উপজেলা নির্বাচনে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই বিএনপির। আপনারা তো দেখেছেনই তারা কিভাবে ভোট করে। যে কোন কৌশলেই হোক না কেন তাদের প্রার্থীদের পাশ করিয়ে নেবেই। এসব নির্বাচনে যাওয়ার কোন মানে নেই।
আজকের সিলেট/বিবি/ডি/এসটি