মিয়ানমারে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফের ক্ষমতা দখল করে মিন্ট সোয়ের নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী। ক্ষমতা দখলের পর দমন অভিযান চালাতে থাকে। মনোযোগ সরে যায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন থেকে, ব্যাহত হয় সামগ্রিক উৎপাদন। ফলে অর্থনীতিতে ধস নামার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও জাতিগত সংঘাতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনসাধারণ। আরাকান থেকেই প্রায় ৮ লাখ বাসিন্দা পালিয়ে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডেও দেশটির অনেক মানুষ নির্বাসনে যায়। ফলে জনমনেও সামরিক সরকারের ওপর আক্রোশ বাড়তে থাকে। সামরিক বাহিনী নিপীড়নের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইলেও বছর তিনেকের মধ্যেই পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে।
অন্যদিকে, সামরিক অভ্যুত্থানের পর অং সান সুচিকে স্টেট কাউন্সেলর করে প্রবাসী সরকারের আদলে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) গঠন করে গণতন্ত্রপন্থিরা। শুরুতে বিদেশে তৎপর থাকলেও পরে দেশে পরোক্ষভাবে জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে শুরু করে এনইউজি। একইসঙ্গে মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বৈধ সরকার হিসেবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছে। বিভিন্ন রাজ্যে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সশস্ত্র জাতিগত গোষ্ঠীগুলো জোট গঠন করে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে জান্তা হটানোর মিশনে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মিয়ানমারের ক্ষমতাধর জান্তা বাহিনীর জাতিগত গোষ্ঠী মূল মিয়ানমারের বামার তরুণদের একটি দলও রয়েছে বিদ্রোহী গ্রুপে।
বামার তরুণদের দল ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’ (পিডিএফ) সম্প্রতি জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর জোট এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশন বা এথনিক রেজিস্ট্যান্স ফোর্স (ইএও) এর সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছে। এই জোটে রয়েছে আরাকান আর্মিও (এএ)।
গত বছরের অক্টোবরের শেষের দিকে একজোট হয়ে সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালায় বিদ্রোহীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় জনসাধারণও। ফলে ধীরে ধীরে মিয়ানমারের জান্তা সরকার খাদের কিনারে পৌঁছতে থাকে। মাত্র কয়েক মাসের প্রতিরোধ যুদ্ধে স্মরণকালের সব থেকে খারাপ সময় পার করছে মিন্ট সোয়ের সরকার।
সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ব্যাপক আকারে রূপ নেয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী এক হয়ে আক্রমণ শুরুর পর। দেশটির উত্তর-পূর্বের শান রাজ্যে প্রথম সামরিক বাহিনীর ওপর একজোট হয়ে সুসংগঠিতভাবে হামলা চালায় জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি’ (এমএনডিএএ), ‘তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি’ (টিএনএলএ) এবং ‘আরাকান আর্মি’ (এএ)। এদের একসঙ্গে বলা হয় ‘থ্রি গ্রুপ অ্যালায়েন্স’।
চলমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত দেখে ধারণা করা হচ্ছে, সেদেশের সেনাবাহিনী বেশ কাবু হয়ে গেছে। কারণ অস্ত্রাগার, সামরিক টহল চৌকিসহ অনেক শহর ইতোমধ্যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। অভ্যুত্থানের পর থেকে বিদ্রোহীদের আক্রমণে এখন পর্যন্ত ৩৫টিরও বেশি শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সামরিক জান্তা। রাখাইন, চিন, কাচিন, শান, কায়া, কাইন রাজ্য ও মান্দালয়সহ কেন্দ্রীয় বিভিন্ন অঞ্চলের একাধিক শহরেও সামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষুণ্ন করেছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। এর ফলে ৫০০টিরও বেশি সেনা চৌকি হাতছাড়া হয়েছে মিন্ট সোয়ে বাহিনীর। এমনকি আটজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলসহ শতাধিক সৈনিক আত্মসমর্পণ করেছে বিদ্রোহীদের কাছে।
আরাকান আর্মির তীব্র আক্রমণে জানুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যেও যুদ্ধ পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। ফলে দুপক্ষের সংঘাতের তীব্রতায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ‘বর্ডার গার্ড পুলিশ’ (বিজিপি) ও বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা এবং সেনা সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে।
সর্বশেষ গত সপ্তাহে বৃহস্পতিবার থাইল্যান্ডে নির্বাসিত বার্মিজ সংবাদ সংস্থা ইরাবতী জানায়, রাখাইনের ঐতিহাসিক শহর ম্রাউক দখলের মধ্য দিয়ে পুরো রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে আরাকান আর্মি।
এরমধ্য দিয়ে প্রথম পূর্ণ একটি রাজ্য জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেল। এর আগে শান ও কাচীন রাজ্যের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ শহর বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রিত সেসব এলাকায় নিজস্ব শাসন পদ্ধতিও চালু করেছে বিদ্রোহীরা। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই জাতিগত দ্বন্দ্বসংঘাতে জর্জরিত মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী এর আগে কখনোই এত বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি। এমনকি দীর্ঘ সাত দশকের প্রতিরোধ যুদ্ধে জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও ছিল মতপার্থক্য জনিত সংঘাত। যার কারণে সেসব আন্দোলন সে অর্থে কখনোই জান্তা সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারেনি।
কিন্তু গত অক্টোবরের পর থেকে শুরু হওয়া তীব প্রতিরোধ যুদ্ধ ভিন্নমাত্রা পেয়েছে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জোট গঠনের পর। জান্তা সরকারকে হটিয়ে কেন্দ্রে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন ও রাজ্যগুলোর পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের শর্তে সশস্ত্র জাতিগত গোষ্ঠীগুলো একীভূত হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, বিদ্রোহী জোটগুলোর ঐক্যবদ্ধতা ও শক্তির উৎসের পেছনে কাজ করছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পরাশক্তি। বিশেষ করে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর গণতন্ত্রপন্থিদের আন্দোলনে ব্যাপক গতি আসে।
যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্টে মিয়ানমারে আন্দোলনরত গণতন্ত্রপন্থিদের মানবিক সহায়তা প্রদানে আইনি বৈধতা ও বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে দেশটির প্রতিবেশী মিত্র দেশ চীন সামরিক জান্তা সরকারের বিশ্বস্ত বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও কাচীন ও শান রাজ্য বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণে নিলে তাদের সঙ্গে সরাসরি কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করে। এমনকি রাখাইনে লড়াইরত আরাকান আর্মিকেও অর্থ ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে চীন সরকার।
তবে দেশটির চলমান পরিস্থিতিতে যত তথ্যউপাত্তই আসুক না কেন; সেগুলোতে পুরোপুরি আস্থা রাখার সুযোগ নেই বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। কারণ স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় থাকা জান্তা সরকার সংঘাত মোকাবিলায় অভ্যস্ত। তবে বিদ্রোহীদের লড়াইয়ে এবার নতুন মাত্রা যোগ হওয়ায় পরিস্থিতি আরও পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “এখানে খেয়াল রাখতে হবে বিদ্রোহী যারা আছে তারা কিন্তু আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করার জন্য আন্দোলন করছে না। তারা স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য আন্দোলন করছে। ফলে এনইউজি ক্ষমতায় আসুক বা বর্তমানে যে জান্তা সরকার রয়েছে তারা থাকুক; এই দুপক্ষের সঙ্গে তারা কী করবে সেটি বেশ জটিল বিষয়। তবে তাদের সামরিক বাহিনী সংঘাত সংঘর্ষে অভ্যস্ত। যদিও এবারের সংঘাতে নতুন মাত্রা দেখা দিয়েছে। এনইউজিকে পশ্চিমা দেশও সমর্থন দিচ্ছে। তবে ভারত এবং চীন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এখনো প্রবেশ করেনি। আমরাও তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় পর্যবেক্ষণ করব।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, “মিয়ানমারের সেনা সরকার ১৯৬২ সাল থেকেই ক্ষমতায় রয়েছে। ফলে সরকারি সব প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে এটা স্বাভাবিক। তবে বিদ্রোহীরা সশস্ত্র সংঘাতে বেশ এগিয়ে আছে। কিন্তু তারা কতদিন সেটি চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে সে প্রশ্ন রয়ে যায়। এছাড়া এই সংঘাতে কেমন ধরনের প্রভাব ফেলবে। এর ফলে কি জান্তা সরকার পরাজয় মেনে নেবে বা ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচনে যাচ্ছে- এগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। মূলত যুদ্ধের ধর্মই হচ্ছে, কেউ এগিয়ে যাবে কেউ পিছিয়ে যাবে। আর যারা পেছনে চলে যায় তারা পাল্টা আক্রমণ করে। ফলে এখন খুবই পরিবর্তনশীল একটা পরিস্থিতি চলমান। এই প্রেক্ষাপটে কোনো ধরনের উপসংহার টানার সুযোগ নেই। তবে এটা ঠিক যে, রাখাইন অঞ্চলে দৃশ্যত নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে বা জান্তা সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। সামরিক আক্রমণের জায়গা থেকে জান্তা হয়ত অনেকটা পিছিয়ে আছে। কিন্তু রাজনৈতিক, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের যে বিষয়গুলো সেটা তো সরকারের ইনফ্লুয়েন্স ম্যাকানিজম আছেই। জান্তা সরকার এটা ভাবেনি তাদের বিরোধী শক্তিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এতটা সশস্ত্র আক্রমণ করবে এবং তাদের এমন চাপের মুখোমুখি হতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত যেটা দেখা যায়, সশস্ত্র সংঘাতের সাময়িক একটা জয় পরাজয়ের বিষয় দাঁড়িয়েছে। কারণ জান্তাবিরোধীদের কাছে এমন কোনো রিসোর্স নেই যে, তারা দেশ শাসন করতে পারবে। তারা কিছু এলাকা দখল করেছে। কিন্তু তা ধরে রাখার মতো সক্ষমতা রয়েছে কিনা সেটি বিবেচ্য বিষয়।”
দেশকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতা ধরে রাখা সামরিক সরকারের দ্রুত ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া উচিত বলেও মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, “মিয়ানমার দীর্ঘ সময় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। দেশকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে সামরিক সরকারের উচিত দ্রুত ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া। তবে জান্তারা দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ করছে। তারা জানে কীভাবে মোকাবেলা করতে হয়। এখানে বৈশ্বিক স্বার্থও যুক্ত হয়েছে। ফলে জান্তাবিরোধীদের সঙ্গে অন্য দেশের যে সম্পর্ক সেটাকে ব্যবহার করেও দেখা যাবে তারা আবার পাল্টা আক্রমণ করে টিকে যেতে পারে। ফলে এগুলো চলতেই থাকবে বলে মনে হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই সংঘাত পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি জটিল করছে। ফলে মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা যায় সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।''
আজকের সিলেট/ডিটি/এসটি