
সুনামগঞ্জে একসময় সুদূর সাইবেরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো মাইল পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় ২১৯ প্রজাতির পাখি আসতো। তারমধ্যে ৯৮ প্রজাতি পরিযায়ী, ১২১ প্রজাতি দেশি ও ২২ প্রজাতি হাঁসজাত। এসব পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠতো প্রান্তিক জনপদের এই এলাকা। কিন্তু বছরে বছরে সেসব পাখির আগমন কমেছে। গত দশ বছরে হাওরে ৮৫ শতাংশ পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমেছে বলে জানা গেছে।
পাখি বিজ্ঞানী ও আইইউসিএনের তথ্যমতে, টাঙ্গুয়ার হাওরে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ২১৯ প্রজাতির পাখি ছিল। পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় প্যালাসিস ঈগল পাখিও আছে এ হাওরে। কালেম, পানকৌড়ি, ভূতিহাঁস, পিয়ংহাঁসসহ প্রায় ২১৯ প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখি থাকার কথা। কিন্তু ২০১১ সালের আইইউসিএনের এক জরিপে টাঙ্গুয়ার হাওরে ৬৪ হাজার পাখির অস্তিত্ব দেখানো হয়েছে। এতে ৮৬ জাতের দেশীয় এবং ৮৩ জাতের বিদেশি পাখির কথা উল্লেখ করা হয়।
তবে বার্ডস ক্লাবের তথ্যমতে, গত দশ বছরে সুনামগঞ্জের হাওরে পাখির সংখ্যা কমেছে ৮৫ শতাংশ। ২০১৫ সালে প্রায় ২ লাখ, ২০১৮ সালে ৬০ হাজার, ২০২২ সালে ৩০ হাজার, ২০২৩ সালে ৪৩ হাজার, ২০২৪ সালে গত ১৫ বছরের তুলনায় সবচেয়ে কম মাত্র ২৩ হাজার পরিযায়ী পাখি এসেছে এই জেলায়।
সরজমিনে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নীল আকাশ, স্বচ্ছ পানি ও চারদিকে শীতল ঠান্ডা বাতাসে অপরূপ প্রকৃতি। তার মাঝে সাদা ডানা মেলে ঝাঁক বেঁধে উড়ছে অতিথি পাখি। যাচ্ছে হাওর কিংবা বিলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সেইসঙ্গে কখনো হাওরের স্বচ্ছ পানিতে খাবারের সন্ধানে ডুব দিচ্ছে আবার কখনো তীরে বসে কিচিরমিচির করছে। সব মিলিয়ে সুনামগঞ্জের হাওরগুলো যেন পাখিদের রাজ্যে পরিণত হয়েছে।
মূলত প্রতিবছর পরিযায়ী পাখি তাদের প্রজনন ক্ষেত্র অথবা শীতকালীন আশ্রয়ের সন্ধানে হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসে বাংলাদেশের এসব হাওর-বিলে। উপযুক্ত আবহাওয়া, খাদ্য এবং বাসস্থানের খোঁজে তারা ছুটে চলে মহাদেশ থেকে মহাদেশে। কিন্তু বর্তমানে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ সুনামগঞ্জের প্রতিটি হাওরে অবাধে পর্যটকদের চলাচল ও পাখি শিকারিদের হানায় ধ্বংস হচ্ছে হাওর, বিলে থাকা পাখিদের স্বাভাবিক আবাসস্থল। আর এতে পাখিদের মূল্যবান আবাসস্থলগুলো হুমকির মুখে পড়ছে।
জেলার পাখিপ্রেমীরা জানান, মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে জেলায় অতিথি পাখির সংখ্যা দিন দিন কমেছে। মূলত পাখি শিকার ও পাচার বন্ধে প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে জেলায় আবার অতিথি পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকবে।
স্থানীয় বাসিন্দা আল মোবারক বলেন, একটা সময় সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা পাখির অভয়ারণ্য ছিল। অথচ আজ এই জেলাটি পরিযায়ী পাখিশূন্য।
স্থানীয় বাসিন্দা তোফায়েল আহমেদ বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ আগে সুনামগঞ্জের ১৩৭টি হাওরের চারদিকে পাখির ওড়াউড়ি দেখা যেত, কিন্তু এখন কেবল সেগুলো অতীত।
স্থানীয় বাসিন্দা আফাজ মিয়া বলেন, অবাধে পাখি শিকার, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বিভিন্ন হাওরে পর্যটকদের ঘোরাঘুরি, শব্দ দূষণের কারণে জেলার হাওরগুলোতে পরিযায়ী পাখির দেখা মিলছে না। পাখি রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন।
স্থানীয় বাসিন্দা সাব্বির মিয়া বলেন, আগে যখন পরিযায়ী পাখিরা টাঙ্গুয়ার হাওরে আসতো, তখন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ তারা খেত। কিন্তু এখন টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছও নেই, পাখিও নেই। জীববৈচিত্র নষ্ট করে হাউজবোটের অবাধ চলাচলে পাখি ও মাছের বংশ বিস্তার একেবারে শেষ।
স্থানীয় বাসিন্দা শফিক মিয়া বলেন, পরিযায়ী পাখি এখন বাংলাদেশের হাওর এলাকায় আসতে ভয় পায়। তারা বেঁচে থাকার জন্য হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এলেও পাখি শিকারিদের ফাঁদে পড়তে হয়। সেজন্য পাখিরাও এখন তাদের গন্তব্য পরিবর্তন করেছে।
বার্ডস ক্লাবের সদস্য সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, পাখি শিকার ও পাচার বন্ধে জেলা প্রশাসন বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করলে আবারো পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠবে হাওর এলাকা।
তবে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, অতিথি পাখি রক্ষায় প্রশাসন সবসময় সতর্ক ও কঠোর অবস্থানে আছে। আমরা সার্বক্ষণিক পাখি রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি।
আজকের সিলেট/ডি/এসটি
