চার খলিফাকে সাথে নিয়ে ছিল মন্ত্রী ইমরানের ‘লুটপাটের সম্রাজ্য’
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৯ PM

আদালতে জনরোষ, ভূয়া ভূয়া শ্লোগান

চার খলিফাকে সাথে নিয়ে ছিল মন্ত্রী ইমরানের ‘লুটপাটের সম্রাজ্য’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৫/০২/২০২৫ ০২:৩২:৪২ AM

চার খলিফাকে সাথে নিয়ে ছিল মন্ত্রী ইমরানের ‘লুটপাটের সম্রাজ্য’


সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি ইমরান আহমদ চৌধুরী। ছিলেন সিলেট ৪ আসনের সংসদ সদস্য। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে ছিলেন মন্ত্রী। তার স্ত্রী নাসরিন শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার বান্ধবী হওয়ার সুবাধে বার বারই পেয়ে যেতেন নৌকার মনোনয়ন। নিজের স্ত্রী পলাতক প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোনের বান্ধবী হওয়ার সুবাধে ছিলেন বেপরোয়া। নিজ নির্বাচনী এলাকার তিনটি উপজেলা সীমান্তর্তী ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর হওয়ার সুবাধে দু’হাত ভরে কামিয়েছেন কড়ি কড়ি টাকা। বালু-পাথর লুটপাট থেকে শুরু করে সীমান্ত চোরাচালানের সিন্ডিকেট চালিয়েছেন দাপটের সাথে। গড়ে তুলেছিলেন লুটপাটের সম্রাজ্য। আর এই সম্রাজ্যে ছিলেন চার খলিফা। মন্ত্রী ইমরানের খলিফারা হলেন- জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী, গোয়াইনঘাটে স্থানীয় সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ (পদত্যাগী) ফজলুল হক এবং কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শামীম আহমদ। ইমরান আহমদ বেশীরভাগ সময় ঢাকায় অবস্থান করার কারনে এই খলিফারাদের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন নিজের সম্রাজ্য। এদের মধ্যে লিয়াকত আলী ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় জনতার হাতে আটক হলেও তিনি রহস্যজনক কারনে জামিন পেয়ে যান। আর বাকি তিন খলিফা এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে।

গতকাল বুধবার সকালে তাকে একটি মামলায় সিলেটের আদালতে উপস্থিত করা হলে বিক্ষোব্ধ জনতার তোপের মূখে পড়েন। এসময় আদালত চত্ত্বওে ভূয়া ভূয়া শ্লোগান দিতে দেখা যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটের সীমান্তবর্তী জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-৪ আসন। পর্যটন কেন্দ্র খ্যাত এই তিনটি উপজেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আড়ালে সেখানে প্রভাব-প্রতিপত্তি, টাকা কামাই আর নানা অপকর্মের অঘোষিত সম্রাট ছিলেন আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমদ। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা আকড়ে রেখে নিজ নির্বাচনী এলাকায় লুটপাটের সম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। বালু ও পাথরকোয়ারির বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ এমন কোনো অপকর্ম ছিল না, যা তিনি করেননি। স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করছে, এসব অপকর্ম থেকে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। কোয়ারি ছাড়াও সীমান্ত দিয়ে অবৈধ চোরাচালানেও ছিল তার একক নিয়ন্ত্রণ। ফলে এই তিন উপজেলায় চোরাচালানের বিষয়টি ছিল অনেকটা প্রকাশ্যেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল আহমদকে নিয়ে জৈন্তাপুরের লিয়াকত আলী শ্রীপুর পাথরকোয়ারির পাশাপাশি তামাবিল স্থলবন্দর নিয়ন্ত্রণ করতেন। লিয়াকতের বিরুদ্ধে জৈন্তাপুর ও তামাবিলে ক্যাডার বাহিনী গড়ে পাথরকোয়ারি, সরকারি জমি দখল, তামাবিল স্থলবন্দরে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সরকার পতনের পর তিনি লাপাত্তা। পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষিত গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে পাথর ও বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতেন গোয়াইনঘাট ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফজলুল হক। সহযোগী ছিলেন তাঁর ভাই শামছুল হক, তাঁদের জামাতা ইমরান হোসেন সুমন ওরফে জামাই সুমন এবং সিলেট জেলা পরিষদ সদস্য সুবাস দাস।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কোম্পানীগঞ্জে ইমরান আহমদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ। ২০১৫ সাল পর্যন্ত এমপির হয়ে শামীমই এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন সব। এরপর দূরত্ব দেখা দিলে কিছুদিন আধিপত্য ছিল চেয়ারম্যান আপ্তাব আলী কালা মিয়ার। তবে জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে এমপির ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন জেলা পরিষদ সদস্য তামান্না আক্তার হেনা। এলাকায় পরিচিতি পান লেডি মাফিয়া হিসেবে। প্রশাসনে তাঁর ছিল একচ্ছত্র প্রভাব। চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নিজেও জড়ান চোরাচালান ব্যবসায়। ‘মন্ত্রী’র লোক হওয়ায় তাঁর চোরাই পণ্যের ট্রাক কোথাও আটকাত না। প্রশাসন বা পুলিশের কেউ নাক গলালে দিতেন বদলির হুমকি। একাধিক ওসি ও এসআই বদলি করে তিনি সেই সক্ষমতাও দেখান। তাঁর দৌরাত্ম্য কোম্পানীগঞ্জ থানার পাশাপাশি গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর থানা পর্যন্ত ছিল। গত ৬ জুন সিলেটে আটক আলোচিত ১৪ ট্রাক ভারতীয় চিনির চালানের নেপথ্যে ছিলেন এই হেনা। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ১৪ ট্রাক ভর্তি চোরাই চিনির মালিক ছিলেন তিনি। এ ঘটনায় বেকায়দায় পড়লেও ইমরান আহমদ সক্রিয় হয়ে তাঁকে রক্ষা করেন।

স্থানীয় লোকজন জানায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৭ সালে কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধের আগে পর্যন্ত ৯ বছরে সংসদীয় আসনের ছয়টি পাথরকোয়ারি থেকে ৬০০ কোটি টাকার বেশি গেছে এমপি ইমরান আহমদের পকেটে। কোয়ারিগুলো হচ্ছে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ, উত্মা ও শাহ আরফিন টিলা, গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি, জাফলং, শ্রীপুর। এর মধ্যে ভোলাগঞ্জে শামীমের একক নেতৃত্বে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা চাঁদা, উত্মা ছড়ায় তামান্না আক্তার হেনা, শাহ আরফিন টিলায় মোহাম্মদ আলী, করিম ও শামীম নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি করতেন। এ সময় প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন। বিছনাকান্দি ও জাফলং নিয়ন্ত্রণ করতেন লিয়াকত আলী। তাঁর পাশাপাশি ছিলেন জামাই সুমন ও আলাউদ্দিন। শ্রীপুর পাথরকোয়ারি নিয়ন্ত্রণ করতেন রাজা মিয়া। সব মিলিয়ে ছয়টি কোয়ারি থেকে প্রতিদিন ৬০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হতো। এর বেশির ভাগই পেতেন ইমরান আহমদ।

উত্তরাধিকার সূত্রে ইমরান আহমদ বিত্তশালী। বাবার আমলের চা-বাগানের পাশাপাশি পাকিস্তানেও তাঁদের পারিবারিক সম্পদ ছিল। নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামা ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের হলফনামায় তাঁর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা। ১৪ বছর পরে ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ৭৬ লাখ ৩৫ হাজার ৭১৯ টাকা, যা ২০০৮ সালের তুলনায় ৬৮ গুণের বেশি।

বেড়েছে স্থাবর সম্পদও। সেখানে আছে শুভংকরের ফাঁকি। ২০০৮ সালের হলফনামা অনুযায়ী তাঁর স্থাবর সম্পদ সাড়ে চার একর জমি, যার অর্জনকালীন আর্থিক মূল্য ৫৫ হাজার টাকা। পাশাপাশি উত্তরাধিকার সূত্রে শ্রীপুর চা-বাগানের ২/১৩ অংশের মালিকানা। ১৪ বছরে বেড়েছে স্থাবর সম্পত্তি। আগের উল্লেখের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২৪.২৭ একর জমি। এটি পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত বলা হলেও ২০০৯ সালের হলফনামায় এর উল্লেখ ছিল না। সর্বশেষ ২০২৩ সালের তথ্য মতে, ১৪ বছরে স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সাড়ে ১৬ গুণের বেশি। যদিও তাঁর নির্বাচনী এলাকার মানুষের ধারণা, প্রকৃত সম্পদের অল্পই হলফনামায় উল্লেখ করেছেন এই দম্পতি।

সিন্ডিকেট করে অর্থ আত্মসাৎ ও মানবপাচারের অভিযোগে সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ, একই মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনসহ ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে ১০৩ জনের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্টন থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।

আফিয়া ওভারসিজ নামের প্রতিষ্ঠানের প্রপ্রাইটার আলতাফ খান নামের এক ভুক্তভোগী মামলাটি করেন। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ২৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন পল্টন থানার ওসি মোল্লা মো. খালেদ হোসেন।

উল্লেখ্য, তার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সিলেটের আদালতে বেশ কয়েকটি মামলা চলমান রয়েছেন। এর মধ্যে গোয়াইনঘাট থানার নং- ২২ (জিআর ১৯১/২৪), তারিখ ২৮/৮/২০২৪। একই থানার মামলা নং -০৪ (জিআর ৩৮৮/২৪) তারিখ ০২/১০/২০২৪ কোতোয়ালি থানার মামলা নং -৩৩, তারিখ :২৮/০৮/২০২৪ উল্লেখযোগ্য।

আজকে সিলেট/ডি/এপি

সিলেটজুড়ে


মহানগর