
মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম হলো নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং শারীরিক-মানসিক সুস্থতা। শ্রমিকদের জীবন ও নিরাপত্তা নানা ঝুঁকির মুখে প্রতিনিয়তই অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। অনেক পোশাক কারখানা আবাসিক ভবন পরিবর্তন করে বানানো হয়েছে, যা শিল্প কার্যক্রমের জন্য উপযোগী নয়।
পুরোনো ভবন, অপর্যাপ্ত স্তম্ভ এবং অতিরিক্ত যন্ত্রপাতির চাপ ভবনের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ভবনে পর্যাপ্ত জরুরি নির্গমন পথ থাকে না বা সেগুলো অবরুদ্ধ থাকে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করাসহ শ্রমিকদের স্বার্থে ২৫টি মূল সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন।
সম্প্রতি কমিশনের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে বিশেষ সুপারিশ করেছে কমিশন। সেগুলো হলো শ্রম আইনে মহিলা শব্দের পরিবর্তে নারী শব্দ ব্যবহার এবং কর্মক্ষেত্রে তুই/তুমি সম্বোধন বন্ধ করা। সেই সঙ্গে নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার কথা বলা হয়েছে, যে সুপারিশ অন্যান্য কমিশনও করেছে।
এ ছাড়া মজুরি দেরিতে হলে শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা ও জাতীয় ন্যূনতম মজুরি : সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। দেশে আট কোটি শ্রমজীবী মানুষ আছে। তার মধ্যে ৮৫ শতাংশ বা সাত কোটি শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নেই। শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিটি এই শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতের সুপারিশ করেছে।
বিশ্বের কোনো না কোনো জায়গায় কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণির দুর্ঘটনা ঘটে। আবার কেউ কেউ চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভোগে। একটি নিরাপদ কর্মপরিবেশ শুধু শ্রমিকের জীবনের জন্যই নয়, প্রতিষ্ঠানের টেকসই উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার কারণে শ্রমিকের উৎপাদনক্ষমতা কমে যায়, প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় এবং সামগ্রিকভাবে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর প্রায় ২.৩ মিলিয়ন মানুষ কর্মক্ষেত্র-সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা বা রোগে প্রাণ হারায়। এছাড়া লাখ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে পঙ্গু হন বা দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভোগেন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিল্পকারখানার দ্রুত প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তার ঝুঁকিও বেড়েছে। এখানে গার্মেন্টস, নির্মাণশিল্প ও কৃষি খাতে কর্মরত শ্রমিকেরা নানা ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখি হন। অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধস, রাসায়নিক দুর্ঘটনা-এসব দুর্যোগ আমাদের এখনো মনে করিয়ে দেয়, সচেতনতা ও নিরাপদ ব্যবস্থাপনা কতটা জরুরি।
টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে শুধু আইনি কাঠামো নয়, সচেতনতা, সংলাপ, বাস্তব প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারখানায় স্থায়ী মেডিক্যাল চেকআপ সেন্টার স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের বছরে অন্তত দুইবার পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে, বিশেষ করে চোখ, ফুসফুস, চর্মরোগ ও স্নায়বিক সমস্যা সংক্রান্ত পরীক্ষা। চিকিৎসক বা প্যারামেডিকের মাধ্যমে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচেতনতামূলক পরামর্শ প্রদান করা উচিত।
সম্পাদকীয়
