রাজনৈতিক পরিবারের অরাজনৈতিক সদস্য আরাফাত রহমান কোকো
রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১১

রাজনৈতিক পরিবারের অরাজনৈতিক সদস্য আরাফাত রহমান কোকো

----------------

প্রকাশিত: ১২/০৮/২০২৪ ০৬:২১:৩৩

রাজনৈতিক পরিবারের অরাজনৈতিক সদস্য আরাফাত রহমান কোকো


আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী  : রাজনীতির চৌহদ্দি স্পর্শ করেনি শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এই সন্তানকে অথবা তিনি সেই স্পর্শ নেননি। রাজনীতির বাইরের কারো মৃত্যুতে এমন শোক ও জানাযায় এতো মানুষের উপস্থিতি এ দেশে বিরল। বায়তুল মোকাররমে স্মরণকালের বৃহত্তম এ জানাযার পর অনেকে একাশিতে কোকোর বাবা শহিদ জিয়ার জানাযার কথা স্মরণ করছেন। জীবদ্দশাতেই দেশের ক্রীড়াঙ্গন বিশেষ করে ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কোকোর অরাজনৈতিক ভূমিকা ও ক্ষমতার স্পর্শহীনতার বিষয়টি ছিল বিশেষভাবে আলোচিত। কিন্তু তিনি আলোচিত বা প্রশংসিত হতে চাইতেন না। এমন অকাল মৃত্যুতে ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন আলোচনায় স্মৃতিচারণ হচ্ছে কোকোর সেই বৈশিষ্ট্য নিয়ে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের আজকের পেশাদারিত্বের গোড়াপত্তনে কোকোর অবদান কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমারও। কোকোর সঙ্গে পরিচয় রাজনৈতিক কারণে নয়, শুধুই ক্রীড়া সংশ্লিষ্টতার কারণে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে আমার কিছু সাংগঠনিক কার্যক্রমের খবর জেনে একদিন তিনি ডেকে নেন আমাকে। সুযোগ দেন ক্রীড়া ক্ষেত্রে আরো ভূমিকা রাখার। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের সুবাদে কাছ থেকে দেখেছি কোকোর কাজের ধরণ। ক্রিকেট নিয়ে তিনি কাজ করেছেন বিদ্যুতের গতিতে। কোকোর স্বভাবে ছিল প্রচার-বিমুখতা। ২০০২ সালে বিসিবির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হয়ে এ পদে তিনবছর ছিলেন তিনি। ওই তিন বছরে বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট কমিটির প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে তিনি আমূল বদলে ফেলেছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটকে। ওই কমিটির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনারই ফসল সাকিব, তামীম, মুশফিকুর, শুভ, এনামুল জুনিয়রের মতো একঝাঁক মেধাবী ক্রিকেটার। তার বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটার পরিচর্যার সেই ধারা এবং ফসল আজও ভোগ করছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। টেস্ট স্ট্যাটাস লাভের পরও এক সময় বর্ষা মওসুমে ক্রিকেটারদের হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হতো। কোকো সেই সমস্যা দূর করে দিয়েছেন। ২০০৪ সালে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ-এনএসসির কাছ থেকে ক্রিকেটের জন্য বরাদ্দ নিয়ে এক সময়ে ফুটবল ও অ্যাথলেটিক্স ভেন্যু থেকে অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাক উপড়ে ফেলে ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে রূপান্তর, ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সুবিধায় আনার ঝুঁকিটা বিসিবি এবং এনএসসি যৌথভাবে নিতে পেরেছে কোকোর কারণেই। শুধু মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামই নয় এনএসসির একসঙ্গে দেশের ৬টি বিভাগে ক্রিকেট ইনডোর স্থাপনের নেপথ্যে ছিল কোকোর অবদান। ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে মাত্র ৬ মাসের মধ্যে বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে ফ্লাড লাইট সুবিধাসহ আধুনিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পরিণত করা কিংবা খুলনা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগীয় স্টেডিয়াম ও ফতুল্লা স্টেডিয়ামকে পরিকল্পিত ক্রিকেট ভেন্যুতে পরিণত করার নেপথ্য কারিগরও ছিলেন তিনিই। প্রতিটি স্টেডিয়ামের পাশাপাশি ইনডোর ফ্যাসিলিটিজ তৈরি করে খেলোয়াড়দের সারা মওসুমই অনুশীলনের মধ্যে রাখার পরিকল্পনাও তার।

বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের পাইপ লাইনের পথ প্রশস্ত করতে জাতীয় দল, ‘এ’ দল এবং এজ গ্রুপের মাঝে ও একটা প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি এসেছিল তার। সেই উপলব্ধি থেকেই বাংলাদেশে পরিকল্পিত ক্রিকেট একাডেমির কর্মকাণ্ডের শুরুটাও তার সময়েই। কোকো ছেলেবেলা থেকেই ক্রিকেট ভক্ত। নিজেও খেলতেন। ক্রিকেটের প্রতি দুর্নিবার টানের সুবাদে তিনি জড়িয়েছিলেন ওল্ড ডিওএইচ ক্লাবের সঙ্গে। ক্লাবটির পর পর দু’বার ২০০৪ ও ২০০৫ সালে প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনেও ক্রিকেটে নিবেদিত কোকোর অবদান স্মরণ করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আমূল বদলে দেয়ার নেপথ্য এই কারিগর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে জানুয়ারি ২৪, ২০১৫, মালয়েশিয়ায় ইন্তেকাল করেছেন। এ অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে বিএনপিকে ঘায়েল করা, দলের চেয়ারপার্সনের শোকসন্তপ্ত মনে আরো শোক-ব্যথা যোগ করাসহ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করায় দু:খজনক চর্চাটি আজকের লেখায় আনতে চাচ্ছি না। অধিকার থাকার পরও বনানী সেনা কবরস্থানে কোকোকে দাফনের অনুমতি না দেয়ার ঘটনাটি একটি মন্দ দৃষ্টান্ত হয়েই থাকলো। বলা বাহুল্য বাংলাদেশের ক্রিকেট টেস্ট স্ট্যাটাস লাভের পরও ছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ও এম আজিজ কেন্দ্রিক। মওসুমের সব খেলাই যখন এ দুই স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করে তখন প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হয় ক্রিকেট। এ বাস্তবতায় আলাদা স্টেডিয়ামের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোকোর অবদান জোর করেও কারো মন থেকে মুছে দেয়া যাবে না। মিরপুর শেরে বাংলাকে হোম অব ক্রিকেট ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্টেডিয়াম, বগুড়া শহীদ চান্দু, খুলনা ও ফতুল্লা স্টেডিয়াম তৈরি ও আধুনিকায়ন এবং আন্তর্জাতিক মানের করা সম্ভব হয় তার জোর প্রচেষ্টাতেই। ২০০৪ ও অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ আয়োজন করে তৎকালীন আইসিসির ভুয়সী প্রশংসা পায় বাংলাদেশ। হরতালের কারণে বিসিবি ওই সময়ে একদিনে ১৫টি প্র্যাকটিস ম্যাচের আয়োজন করে তাকলাগিয়ে দিয়েছিল আইসিসিকে। অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ও স্টেডিয়ামের আধুনিকায়নের সূত্র ধরেই পরবর্তীতে স্টেডিয়ামগুলো আন্তর্জাতিক অনুমোদন লাভ করে। আর মিরপুরকে হোম অব ক্রিকেটে রূপ ও ওটা দেখিয়েই ২০১১-এর বিশ্বকাপের অনুমোদন লাভ করেছিল তৎকালীন বিসিবির আমলেই। তার উন্নতির চিন্তাধারাতেই সূচনা হয় চিন্তাধারাতেই বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, হাইপারফরমেন্স, ট্যালেন্ট হান্টিং তথা জাতীয় দলের পাইপলাইনে ক্রিকেটার তৈরির কাজ। তার চিন্তাধারায় থাকত শুধুই দেশের ক্রিকেটকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সম্মানের সাথে তুলে ধরা। আর এ জন্য তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিভা খুঁজে বের করে প্রতিভার লালন ও পরিচর্যা কিভাবে সম্ভব, তার পথ তিনিই সৃষ্টি করেছেন। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাথে তার ব্যক্তিগত ও সম্পর্কের বেনিফিসিয়ারি হয়েছে বাংলাদেশ। সে সূত্র ধরেই অস্ট্রেলিয়ান বোর্ডের সাথে তখন বিসিবির একটা চুক্তি হয়। বাংলাদেশ বয়সভিত্তিক থেকে শুরু করে সবপর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ান কোচ, ট্রেনার, ফিজিও পেত বাংলাদেশ। বোর্ডের প্রফেশনাল কাজেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্ট পাওয়া যেত। ক্রিকেট বোর্ড ছিল তখন রাজনীতিমুক্ত। কাজটি করতে গিয়ে জনপ্রিয়তা বা বাহবা কুড়াতে যাননি কোকো। প্রেসকে ডেকে কাভারেজের আয়োজন করেননি। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সব মতের সংগঠকেরাই ছিলেন বোর্ডে। আরাফাত রহমানের নেতৃত্বে কাজ করে কাছ থেকে ক্রিকেটকে নিয়ে কোকোর উচ্চাভিলাষী কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করা ব্যক্তিত্বদের এ শোক ভুলবার নয়।

ক্রিকেট অঙ্গনে তার অরাজনৈতিক চেতনার একটা উদহরণ হলো বগুড়া স্টেডিয়াম। বগুড়া এবং দলীয় কোনো কোনো পর্যায়ে থেকে দাবি এসেছিল বগুড়ার সন্তান হিসেবে শহীদ জিয়াউর রহমানের নামে নামকরণের। কোকো তা আমলে না নিয়ে দিয়েছেন একজন শহীদ চান্দুর নাম। এমন দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে খুব কম। তার মৃত্যুতে বেগম জিয়া সন্তান হারিয়েছেন। আর দেশ হারিয়েছে একজন সত্যিকারের ক্রিকেটপ্রেমীকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সুন্দর একটা ভিতরে ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়ার এই কারিগরকে ভুলবেন না সংশ্লিষ্টরা। মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর ৫৫তম জন্মবার্ষিকী আজ, তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। এমন ক্রিকেট সজ্জনকে আল্লাহ বেহেস্ত নসীব করুক।

(লেখক, সভাপতি, সিলেট জেলা বিএনপি। সাবেক পরিচালক ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।)

সিলেটজুড়ে


মহানগর