অনাদরে বাংলা ভাষা
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৪২

অনাদরে বাংলা ভাষা

----------------

প্রকাশিত: ১৩/০২/২০২৪ ১২:০২:৪৫

অনাদরে বাংলা ভাষা


আলী রেজা : রাজা শশাঙ্কের শাসনামলের অবসান হলে বাংলায় কোনো রাজশক্তির উত্থান না হওয়ায় কিছুকাল ব্যাপক অরাজকতা বিরাজ করে। সবলেরা দুর্বলের উপর অত্যাচার শুরু করে। বাংলার এই দুঃসময়কে ইতিহাসে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলে অভিহিত করা হয়। পাল রাজাগণ ক্ষমতায় এসে বাংলায় বিরাজমান এই অরাজকতা দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পালশক্তির খ্যাতি বাংলা থেকে সর্বভারতে এমনকি ভারতবর্ষের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল।

রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছিলেন পাল রাজাগণ। কিন্তু পাল রাজাদের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ছিল একমুখি। তাই তখন সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি বিশেষ ভাষা (সংস্কৃত) ও একটি বিশেষ ধর্মের (বৌদ্ধধর্ম) ব্যাপক পৃষ্টপোষকতা দিয়ে পাল রাজাগণ অন্যান্য ভাষা ও ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন। তাই পাল যুগে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ঐক্য যতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাংস্কৃতিক ঐক্য ততটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল সংস্কৃত ভাষা ও বৌদ্ধ ধর্মকে ঘিরেই। সংস্কৃত ভাষা ও বৌদ্ধধর্মকেন্দ্রিক এই উন্নয়ন ও অগ্রগতি অন্যান্য ভাষা ও ধর্মের অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছে।

সংস্কৃত ভাষায় রচিত ইতিহাস, আইন, ধর্মাচরণ ও চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশ ও বৌদ্ধ বিহার বা বিদ্যাকেন্দ্রগুলোতে সেগুলো গুরুত্বের সাথে পঠিত হলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা ততটা গুরুত্ব পায়নি। ফলে বাঙালি পণ্ডিতগণ সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’গুলো অষ্টম শতক থেকে রচিত হলেও চারশত বছরের পাল যুগে সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। চর্যাপদের পাণ্ডুলিপি চলে গিয়েছিল বাংলার বাইরে নেপালে। এতে বোঝা যায় তখন চর্যাপদ অনাদরেই ছিল।

অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত প্রবল প্রতাপ নিয়ে বাংলা শাসন করলেও পাল রাজাগণ সংস্কৃত ভাষা ও বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব করেছেন, বিশেষ পৃষ্টপোষকতা দিয়েছেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সুদৃষ্টি থাকলে পাল আমলেই চর্যাপদ আলোর মুখ দেখতো এবং বাঙালি পণ্ডিতগণ ব্যাপক হরে বাংলার পরিবর্তে সংস্কৃত ভাষা চর্চা করতেন না। তাই সুদীর্ঘ পাল যুগেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কোনো প্রকার সমাদর লাভ করেনি। এই সাংস্কৃতিক শোষণ অব্যাহত ছিল পরবর্তী যুগেও।

পাল রাজবংশের পতনের পর বাংলায় সেনবংশ রাজত্ব করে প্রায় দু’শ বছর। পাল যুগের মতো সেন যুগেও সংস্কৃত ভাষা বিশেষ রাজানুকূল্য পায়। সেন যুগেও খ্যাতিমান বাঙালি পণ্ডিতগণ সংস্কৃত ভাষা কাব্য রচনা করেন। ফলে সেন যুগেও সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে বাংলায় বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সেন যুগের দু’শ বছরে বাংলায় সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোনো ভাষা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি।

বিশেষ রাজানুকূল্যে একটি বিশেষ ধর্ম ও ভাষা শক্তিশালী হয়ে উঠলে সাধারণ মানুষের অন্যান্য ধর্ম ও ভাষা দুর্বল হয়ে যায়। ফলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। ধর্ম সাধারণ মানুষের প্রধান পালনীয় বিষয়। আর ভাষা হলো শিক্ষার মাধ্যম। তাই এ দুটি বিষয়ে শাসক শ্রেণির পক্ষপাতিত্ব জাতিগত সংকট সৃষ্টি করে। এটা এক ধরনের সাংষ্কৃতিক শোষণ এবং এই শোষণ পাল যুগের মতো সেন যুগেও বাংলায় বিরাজমান ছিল।

বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের ফলে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তা প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছরেরও অধিককাল (১২০৪- ১৭৫৭ খ্রি.) স্থায়ী হয়। এ সময় বাংলার সাধারণ মানুষের সাথে শাসক শ্রেণির কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বাংলার সাধারণ প্রজাবর্গ তখন শাসকের জয়-পরাজয় কিংবা পরিবর্তন নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। রাজ সিংহাসনের প্রতি অনুগত থাকাই ছিল প্রজার ধর্ম। তাই রাজার পরিবর্তনে সাধারণ প্রজার জীবনের কোনো পরিবর্তন হতো না।

ইলিয়াসশাহি ও হোসেনশাহি বংশের শাসনামলে উল্লেখযোগ্য সামাজিক পরিবর্তনের ফলে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। পাল ও সেন যুগের সংস্কৃত প্রভাব থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য মুক্তি পায়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। সেনযুগে উজ্জীবিত হিন্দু ধর্ম এ যুগে এসে কোনো সংকটে পড়েনি। ফলে বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয় ধর্মই রাজানুকূল্য লাভ করে।

ইলিয়াসশাহি শাসনামলে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত মহাকাব্য ও কিছু কিছু পৌরাণিক উপাখ্যানের অনুবাদ হয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয় এ সময়ই অনুবাদ হয়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি ইলিয়াসশাহি শাসকদের পৃষ্টপোষকতার এই ঐতিহ্য হোসেনশাহি যুগেও অব্যাহত ছিল। বলতে গেলে হোসেনশাহি আমলে বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ ঘটে।

এ যুগে আলাওল ও দৌলত কাজির মতো পণ্ডিত ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাঁদের ভাবপ্রবণ ও মানবতাবাদী কাব্য বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। হোসেনশাহি আমলে যশোরাজ খান, কবীন্দ্র পরমেশশ্বর, শ্রীকর নন্দী, শ্রীধর- প্রমুখ পণ্ডিতগণ রাজদরবারের পৃষ্টপোষকতা লাভ করেন। বিজয়গুপ্ত ও বিপ্রদাস এ যুগেই মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন।

দীর্ঘদিন ধরে আরবদেশ ও উত্তর ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে এবং বাংলার জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার ফলে বাংলার সুলতানগণ বাঙালিধর্মী হয়ে ওঠেন এবং বাংলার ভাষা ও সাহিত্য মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন। মুসলিমপূর্ব পাল ও সেন যুগে বাংলায় সংস্কৃত ভাষার যে প্রভাব ছিল, মোগলপূর্ব মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষা সেই প্রভাব লাভ করে।

তবে মোগল আমলে এসে মোগলপূর্ব মুসলিম শাসনামলে বিদ্যমান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাব খর্ব হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য রাজানুগ্রহ থেকে বিতাড়িত হয়। এ সময় রাজভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে ফারসি ভাষা। পাশাপাশি আরবি-উর্দু ভাষারও কদর বাড়ে। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হয় ফারসি ভাষা। এজন্য উচ্চ সরকারি পদ লাভের আশায় অভিজাত হিন্দুরাও ফারসি ভাষা শেখা শুরু করে। কবি রামপ্রসাদ সেন, কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, রাজা রামনারায়ণ প্রমুখ পণ্ডিতবর্গ ফারসি ভাষায় বুৎপত্তি লাভ করেন এবং ফারসি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

বাংলার নবাব ও মুসলিম অভিজাতগণ ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্টপোষকতা প্রদান করা শুরু করেন। এভাবে ইরান তথা পারস্যের ফারসি ভাষা বাংলায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তখন সাধারণ মানুষের ভাষা ও সাহিত্যে পরিণত হয়। এভাবে আবার বাংলা ভাষা সাংস্কৃতিক শোষণের শিকার হয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এই ফারসি ভাষার অনেক শব্দ বাংলা ভাষায় স্থায়ী আসন লাভ করে ঐ সময় বাংলা ভাষার বিকাশ ব্যাহত হয়। বাংলা ভাষা নিম্নবর্গের মানুষের ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয় বলে যথাযোগ্য মর্যাদা থেকে বিতাড়িত হয়।

মোগল আমলের শেষের দিকে ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিরা বাংলায় আসতে শুরু করে। মূলত তাঁরা ধর্ম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। তবে তাঁরা ইংরেজিভাষী ছিলেন বলে তাঁদের সংস্পর্শে এসে অনেক বাঙালি ইংরেজি ভাষা শিক্ষা লাভ করে। এভাবে বাংলায় ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটে। বাংলায় ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা হলে ফারসি ভাষার বদলে ইংরেজি ভাষা রাজভাষার মর্যাদা লাভ করে।

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সাধারণ মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি হিসেবেই থেকে যায়। রাজানুকূল্য পাওয়ার জন্য অনেক অভিজাত বাঙালি পণ্ডিত ইংরেজি ভাষা চর্চা করা শুরু করে। এ ক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান সম্প্রদায়ের চেয়ে এগিয়ে যায়। কারণ মুসলমানদের কাছে তখন ইংরেজি ভাষা বিজাতীয় এবং ধর্মীয় দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি।

বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ও রাজনৈতিক অধিকারবোধপ্রসূত জাতীয়তাবাদী চেতনার ফলে ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা বাড়তে থাকে। নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা বাড়াতে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন বাঙালি কবি-সাহিত্যিকগণ। বিশ শতকের গোড়া থেকেই ব্রিটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রামে জাতীয়তাবাদী চেতনা জোরালো হতে থাকে। প্রত্যেকটি আন্দোলন-সংগ্রামের চেতনায় গণসাহিত্য ও গণসংগীত রচিত হয়।

রাজভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষায় দাপ্তরিক কাজ করা হলেও জনচেতনার ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। তারপরও ব্রিটিশ আমলে বাংলা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করেনি। বাংলা সাধারণ মানুষের সাধারণ ভাষা হয়েই থাকে। শাসকগোষ্ঠী ও শাসকগোষ্ঠীর আশীর্বাদপুষ্ট একটি শ্রেণির ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষাই বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয়। উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিতদের অনেকেই ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করেন। উচ্চশিক্ষার মাধ্যমও ছিল ইংরেজি ভাষা, যার প্রভাব এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাঙালি জাতি।

প্রায় দু’শ বছরের ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। প্রায় দুই যুগের পাকিস্তান আমলেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ভাষা বাংলাকে কোণঠাসা করে রাখার নানা অপকৌশল হাতে নেয়। মুসলিম লীগের মাধ্যমে এই অপকৌশলের শুরু হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির এক দশক পূর্বে। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা উর্দু করার প্রস্তাব করেন।

এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন বাংলার নেতা এ কে ফজলুল হক। ১৯৪৭ সালের ১৮ই মে হায়দারাবাদের ‘উর্দু সম্মেলন’-এ উত্তর ভারতের মুসলিম লীগ নেতারা ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ বলে ঘোষণা দেন। একই বছর জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হকসহ পূর্ববাংলার বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কিন্তু এই বিরোধিতাকে আমলে না নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে পাকিস্তান সরকার মুদ্রা, পোস্টকার্ড, চিঠির খাম প্রভৃতিতে ইংরেজি ও উর্দু ভাষা চালু করেন। অফিস-আদালতের ভাষাও ইংরেজি ও উর্দু করা হয়। পাকিস্তানের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই বাংলা ভাষা যথাযোগ্য মর্যাদা থেকে বিতাড়িত হয়। সে প্রেক্ষাপটেই সংঘটিত হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান সংগ্রাম ভাষা আন্দোলন।

(লেখক : কলেজ শিক্ষক ও কলামিষ্ট। পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।)

সিলেটজুড়ে


মহানগর